হতেম যদি মানুষ

। পুষ্পিতা দাস ।

- ও আপনি?
- কতটুকু লাগবে?
- এইতো, কাটার পর দেড়-দুকেজি হলেই হবে।
-ঠিক আছে। রেডি করে রাখছি। আপনার বাকী কাজ সেরে একটু দূরে দাঁড়াবেন। আমরা আপনার হাতে দিয়ে আসব।
হ্যাঁ আমিই তো বলেছি কথাগুলো - কাউকে কেটে ফেলতে! বলার পরপরই বার বার মনে হচ্ছে এইতো আমি সরে পড়লাম, আর জ্যান্ত একটি প্রাণীকে গলা কেটে হত্যা করে সুন্দরভাবে প্যাকেট করে আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে। ভেবে শরীর মন শিউড়ে উঠছে। এটা কী করছি আমি! মন বিষাদগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু পর মূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিচ্ছি। মনকে মানিয়ে নিলেই তো হলো! ওরা তো আমাদের খাদ্য! নিজে না হয় না-ই খেলাম। কিন্তু প্রিয়জনদেরকে রান্না করে খাওয়াতে তো হবে। নাহলে তো খাবার মুখে রচবে না ওদের! কখনও বা ঘরে আত্মীয়স্বজনরা নিমন্ত্রিত - মাছ-মাংস ছাড়া খাবার জমবে? নিজের চোখে এসব দেখতে পারব না তাইতো সরে এসে দাঁড়ালাম। আবার খাবার প্লেটো কেউ সুস্বাদু আইটেম এর নামে সাজিয়ে দিলে দিব্যি খেয়ে নেব। একেই মনে হয় বলে হিপোক্রিসি।

কর্মক্ষেত্রে কিংবা অন্য কোথাও, যেখানেই যাই না কেন, মাংসের দোকানগুলো পেরিয়ে যেতে হয়। আর আমাদের এই শিলচর শহরে যানজট একটি নিত্যদিনের ঘটনা, মনে মনে প্রার্থনা করি যেন এই মাংসের দোকানের সামনে গিয়ে গাড়ী আটকে না যায়। চোখ পড়লেই তো দেখবো ঐ অসহায় মুখগুলো নিষ্ঠুরতম মৃত্যুর অপেক্ষায়। চোখ ঠিকরে জল বেরিয়ে আসা। আর বিষণ্ণ মন নিয়ে পুরো দিন কাটানো। এরা না-কি আমাদের খাদ্য! আমাদের মতই এরা প্রাণোচ্ছল, আমাদের মতই এরা ভালোবাসে, ভালোবাসা বোঝে, ব্যথা পেলে ওরাও কাঁদে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের শরীরে একটি সূচ বিঁধলে যতটুকু ব্যথা আমরা পাই, ততটুকু ব্যথা তারাও পায়। আর আমরা এসব কিছু জেনেও তাদের কেটে ফেলছি শুধুমাত্র নিজেদের জিহ্বার স্বাদ মেটানোর জন্য। চরমতম কষ্ট দিচ্ছি। ওরাও তো আমাদের মতই বাঁচতে চায়, নিজের সঙ্গীকে ভালোবাসে, কখনও ঝগড়া করে, নিজের সন্তানকে ভালোবাসে, রক্ষা করতে চায় আমরা মানুষদের মতন করেই। কখনও ভেবে দেখেছি আমরা এসব? না, কেনো ভাববো? আমরা তো ধরেই নিয়েছি ওরা আমাদের খাদ্য। চিকেন, মাটন, বিফ, পর্ক এসব আমরা মানুষের প্রিয় খাদ্যতালিকার অন্তর্গত। কিন্তু আমাদের খাবারের প্লেটে বিভিন্ন রকমারী নাম নিয়ে সুসজ্জিত ভাবে পরিবেশিত হবার আগে এরা কী চরম কষ্ট সহ্য করেছে তা আমরা চিন্তা করেছি কখনও? আমাদের সন্তানের কিংবা প্রিয়জনের (আর নিজের?) শরীর থেকে একবিন্দু রক্ত ঝরলে আমরা আঁতকে উঠি, অথচ ওদের থেকে ওদের সন্তানকে, কখনও সন্তানের থেকে মাকে নিয়ে আমরা হত্যা করছি শুধু আমাদের খাবারের নামে। মনে প্রশ্ন জাগে- কে দিয়েছে আমাদেরকে এই অধিকার?

সঠিক জানা নেই, কত শত বছর আগে থেকে পশুহত্যা শুরু হয়েছিল আমাদের খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য। একটা সময় ছিল যখন পৃথিবী প্রযুক্তির দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে ছিল এবং অনেক জায়গায় আবহাওয়ার কারণে ফসল ফলানো-সম্ভব হতো না, আর যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনুন্নত হওয়ার দরুন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খাদ্যসামগ্রী পৌছানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা সভ্যতা ও প্রযুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌছে গেছি। কিন্তু আমাদের পাশবিকতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারলাম কি? আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলস্ এর নামে, কখনও বা ধর্মের নামে কিংবা উৎসবের অছিলায়, পশুহত্যা আমাদের অভ্যাসে পরিণত। এদিকে আবার কারও কারও রেডমিট নিষেধ স্বাস্থ্যের স্বার্থে, আর পোলট্রি চিকেন কতটুকু স্বাস্থ্যকর, তা আমরা সবাই জানি। এবার আসি মাছের কথায়। মাছের বাজারে গিয়ে যখন ছোটো - বড় মাছের দামাদরি করি, তখন তো আমাদের মনেই পড়ে না যে ওরা একসময় জীবিত ছিল, নিজের বাসস্থান জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল, আমাদের জিহ্বার জ্বালা মেটাতে তাকে তিলে তিলে মরতে হয়েছে। আর যখন দেখি, এদের মধ্যে কেউ বেঁচে আছে, শ্বাস নিতে যুদ্ধ করছে ,তখন উৎফুল্লিত হয়ে উঠে বলি--মাছটি ফ্রেশ। 

মাছে-মাংসে অভ্যস্ত আমাদের কাছে কতরকমের মুক্তি রযেছে--এদের নাখেলে এরা নাকি সাংখ্যায় এতটা বেড়ে যাবে যে চারদিকে নাকি শুধু এদেরকেই দেখা যাবে। অথচ আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য এখন এদের চাষ করতে হচ্ছে, আর এই চাষ করতে গিয়ে আমাদের পরিবেশ কিভাবে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের ভেবে লাভ কি! কখনও আবার ধর্মের বাহানা। বলি, কোনো ধর্মগ্রন্থে যদি পশুহত্যার কথা বলা হয়েও মাকে, এটাই আমাকে মেনে নিতে হবে? আমরা না মানুষ,-- ঈশ্বরের সৃষ্ট পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। মানবিকতার চাইতে বড় ধর্ম আমাদের কাছে আর কী কিছু হতে পারে? আর কোনোও ধর্মগ্রন্থে যদি পশুবলির কথা বলা হয়েও থাকে, সেটা মানুষের মধ্যে যে পশুত্বগুলো রয়েছে- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহঙ্কার, মাৎসর্য- সেগুলোকে যে ঈশ্বরের সামনে বলি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা আমরা কবে বুঝব? আমরা যে সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে বা যে দেবীর উদ্দেশ্যে একটি নিষ্পাপ প্রাণকে নিয়ে বলি দিয়ে দেই, সেই সর্বশক্তিমান যদি আমাদের সৃষ্টিকর্তা হয়ে থাকেন, তবে সেই প্রাণীটিও তাঁরই সন্তান, সেই দেবীমা প্রকৃতির মা, তিনি তাঁর সন্তানের রক্ত চাইবেন? সেই নিষ্পাপ প্রাণীটি হয়ত আমাদের চাইতে তাঁর কাছে অধিকতর প্রিয়, কারণ তার মনে মানুষের মনের ও চরিত্রের মলিনতাগুলো নেই। আবার কখনও আমরা বলি এদেরকে নকি আমাদের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মানে কি এই, যে আমরা এদেরকে ভোগ করব? না, বরং আমরা এদেরকে রক্ষা করব, কারণ এরা আমাদের চাইতে দুর্বল, আর দুর্বলকে রক্ষা করাটাই মানুসের ধর্ম। কিন্তু আমরা ঠিক উল্টোটা করছি।

এখানেই তো শেষ নয়---
আমাদের প্রিয় খাদ্য- ডিম, দুধ, পনীর, ঘি, অন্যান্য ডায়েরি প্রোডাক্টস, এসবের পেছনের সত্যটা আমরা কখনও যাচাই করে দেখেছি? কতটা নৃশংসতা প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে এই নিষ্পাপ প্রাণগুলোকে সহ্য করতে হয়, আমাদের খাদ্যের রকমারী স্বাদ মেটানোর জন্য। সত্যি,আমরা সভ্যতা, প্রযুক্তিতে যতটা এগিয়ে যাচ্ছি, ততটাই নির্মম, নিষ্ঠুর হয়ে উঠছি। একবার এদের কথা ভাবলে আমাদের দুঃখ কষ্টগুলো বড়ই অবাস্তব এবং অবান্তর দেখায়। আর সত্যি বলতে আমাদের লোভের জন্য এ পৃথিবীর একটি প্রাণীও যদি কষ্ট পায়, তাহলে আমরাও এ পৃথিবীর কোনো সুখের আশা রাখার অধিকারী নই। অথচ আমরাই আবার সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করি বিশ্বশান্তির জন্য। যে পৃথিবীতে প্রতিদিন কোটি কোটি প্রাণীকে হত্যা করা হয়, শোষন করা হয় নৃশংসভাবে (নৃশংসতা বললে কম বলা হবে,সঠিক শব্দ আমার কলমে আসছে না), সেই পৃথিবীতে শান্তি আসবে কোথা থেকে? বিশ্বশান্তি শুধু মানুষের জন্য? এত মহান আমরা? 

আমরা মানুষেরা নিজেদের জিহ্বার স্বাদানুসারে, জীবনের প্রয়োজানুসারে কোন প্রাণীকে খাবো, আর কা-কে পোষ্য হিসেবে নিজের কাছে রাখব,আদর-যত্ন করব, সেটাকে ভাগ করে নিয়েছি। সবেতেই স্বার্থ, মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে আমাদের ভালোবাসার বিলাস। অথচ একটিবারের জন্য এটাও ভাবছি না, যাকে কোলে তুলে আদর করছি, আর যকে কেটে খাচ্ছি তাদের মধ্যে তফাৎটা কোথায়!

কখনও আমাদের খাদ্য, কখনও আমাদের বিনোদন, কখনও আমাদের বাহক বা বাহন - কোনো কিছুর জন্যই ওদের ছেড়ে দিইনি। যতটুকু না এই অবলা প্রাণীগুলো আমাদের নৃশংসতার কাছে অসহায়, তার থেকে বেশী- আমাদের মনুষ্যত্ব যেন অমানবিকতার কাছে বন্দী। আমাদের লোভ-লালসা ভোগ-বিলাস এতটা বেড়ে গেছে যে মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে - মনে হয় বিজ্ঞান আজ এতটা এগিয়ে গেলো কিন্তু এদের জন্য সহজ-মৃত্যুর কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারলো না? তবে এই নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা যতই আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে পরুক না কেন, চাইলে আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না, তা মোটেও নয়।

বলি সত্যি সত্যি হতেম যদি মানুষ, তবে কি পাঁচ দশ মিনিটের জিহ্বার স্বাদের পরিবর্তে এদের হত্যাকে , এদের উপর হওয়া অকথ্য অত্যাচারকে আমরা মেনে নিতে পারতাম?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : অনলাইন-২৯

  এই সময়টা আমার নয়           । শৈলেন দাস । এই সময়টা আমার নয় মেঘে বাদলে জুটি কালবৈশাখী ঝড়ে তছনছ সেই ঘর যেখানে আমি থাকি। পুরো কবিতাটি পড়ু...