।।রেবতী মোহন দাস।।
সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম আমার । অভাব অনটনের জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর সংসারের কাজে লেগে যাই। এমন কোন কাজ নেই যা করিনি। পড়াশোনা ছাড়ার 6 বৎসর পর আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে 1975 ইং মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করি শ্যামাচরণ দেব বিদ্যাপীঠ শিলচর থেকে। তারপর ইন্টারমিডিয়েট কাছাড় কলেজ থেকে প্রথম বর্ষ পাশ করে দ্বিতীয় বৎসর পরীক্ষা দিতে পারিনি কারণ সেই দারিদ্রতা। লেগে যাই কাজে। গৃহস্থী, মাছ মারা আরো কত কিছু । কিছু দিন পর অবস্থার উন্নতি হল। তখন মনে হল অনেক গরিব ঘরের ছেলে মেয়েরা পিতামাতার অবহেলার জন্য পড়তে পারে না । আমি চেষ্টা করব ওদের জন্য কিছু করতে । আমাদের গ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্রীযুক্ত গোপেশ রঞ্জন দাস মহাশয়ের প্রেরণায় আমাদের বাঘমারা গ্রামের পাশেই এক্স-টি গার্ডেন শ্রমিক 6 নং (আইরংমারা) গ্রাম । বর্তমান আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে দেওয়ালের নিকটে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গন্ধই ছিল না, 1977 ইংরেজির কথা। গ্রামের লোকেরা দিবারাত্র সমানভাবে মাদকে আসক্ত ছিল সেই গ্রামে পরপর কয়েকটি সভা করে উনাদের মতামত নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য প্রাথমিক ভেঞ্চার স্কুল স্থাপন করি। না ছিল ঘর না ছিল আসবাবপত্র। আমি উনাদের সাথে গিয়ে জঙ্গল থেকে বাঁশ এনে একটি ঘরের ব্যবস্থা করি। ছন বাঁশের ঘর কতদিনই বা টিকবে? ভেঙ্গেও গেল। তখন গাছ তলায়, গোয়াল ঘরে, মানুষের ঘরের বারান্দায় ক্লাস করেছি। বইপত্র, খাতা, কলম জোগাড় করতে আমার যে কি কষ্ট হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তার উপর নেশাখোর মানুষের উৎপাত- 'আমাদের স্কুল লাগবে না'। কিন্তু ওই গ্রামেরই কিছু মুরব্বি আমাকে বলতেন মাস্টারবাবু এদের কথায় কান দেবেন না । অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি প্রায় প্রতিজ্ঞাই করে ফেললাম আমি স্কুল বানাবোই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আসলো সেই শুভ দিন, 1983 ইংরেজির পহেলা অক্টোবর । আসাম সরকার স্কুলটি প্রাদেশিকরন করলো । এর পূর্বে অনেকবার গুয়াহাটি যাওয়া আসা করতে হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাহায্য পেয়েছি। স্কুলের অবস্থা ভালো ছিল না। তখন ধলাইর বিধায়ক ছিলেন আমার বন্ধুবর বর্তমান আসাম সরকারের বরিষ্ঠ মন্ত্রী শ্রীযুক্ত পরিমল শুক্লবৈদ্য মহাশয়। উনাকে বললাম স্কুল তো হল ঘরের কি হবে? তখন তিনি এক লক্ষ টাকা দিলেন। একটা পাকা ঘর হয়ে গেল। তখন থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। স্কুলে শিক্ষক আমি একা। ডি.আই. মহোদয় কে বলে আরো একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হলো। ভালো মতে স্কুল চলছে।
চাতলা হাওর তথা আশেপাশের বেশ কিছু স্কুল নিয়ে বাঘমারা কেন্দ্র। সম্পাদক ছিলেন শ্রীযুক্ত গোপেশ রঞ্জন দাস। উনার ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য আমাকে বললেন কেন্দ্র সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে। নুতন চাকুরী বয়স কম, এগুলি আমি বুঝিনা। কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে নির্বাচিত করা হলো কেন্দ্র সম্পাদক হিসাবে। দীর্ঘ 18 বৎসর সততার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছি। আসলো 2003 ইং, সর্বশিক্ষা আরম্ভ হলো। সি. আর. সি. সি. নিয়োগ করা হবে। উক্ত পদের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হলো। আমি নির্বাচিত হয়ে তরুতাজাবাড়ি সি. আর. সি. সি. তে নিযুক্তি পেলাম। দীর্ঘ 10 বৎসর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। অনেক ট্রেনিং করেছি।
ধীরে ধীরে আমার অবসর গ্রহণের সময় এগিয়ে আসতে লাগল। 2015 ইংরেজির 15 ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিনে আমি একটি সভা ডাকলাম আমার স্কুলে। সেই সভায় শ্রীযুক্ত পরিমল শুক্লবৈদ্যসহ রাজনীতিবিদরা, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্কুলের বর্তমান কর্মরত এবং প্রাক্তন শিক্ষক শিক্ষিকা বৃন্দ, গ্রামের মুরব্বি বৃন্দ সহ সর্বস্তরের জনসাধারণ ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিলেন। আমি সভা কে উদ্দেশ্য করে বললাম -'যে জায়গায় স্কুল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। সেই জায়গায় সর্বশিক্ষার কারণে তিনটা পাকা স্কুল গৃহ, রান্নাঘর, শৌচালয়, জলের কল সহ সবরকমের সুবিধা তৈরি হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ চাকুরী জীবনে যদি ভুল ভ্রান্তি কিছু করে থাকি তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এই গ্রামের জনসাধারণ আমাকে দেবতার মতো মান্য করেছে। ওদের সর্বপ্রকার সামাজিক কাজে আমি অংশগ্রহণ করেছি। 48 বৎসর পূর্বে গ্রামের যে অবস্থা বা পরিবেশ ছিল তা আজ আর নেই। প্রত্যেক ঘরের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন স্কুলে কলেজে পড়ছে। সত্যিই যাহা ভালোলাগা এবং আনন্দের বিষয়।' সভায় বিভিন্ন বক্তা নিজ নিজ বক্তব্যে প্রশংসায় আমাকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সকলের শেষে বক্তব্য রাখেন মাননীয় পরিমল শুক্লবৈদ্য মহাশয় । উনার বক্তব্য বলেন, আজ তো বিদায় সভা নয় তবে কেন এই সভার আয়োজন? কেহ তো এরকম করেননি আপনি কেন করলেন? আমি বললাম, কেউ এমন সভা করে না বলেই তো আমি করলাম। আমি আরো বললাম মজুমদার বাজারে একদিনের জন্য একটি প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল, সেই শিবিরে সি. আর. সি. সি., কেন্দ্র সম্পাদক, প্রধান শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন প্রায় 250 জনের মতো। শিবিরে গুয়াহাটি থেকে আগত প্রশিক্ষক মহাশয় প্রশ্ন করেছিলেন -আপনাদের ছেলে-মেয়েরা কি আপনাদের স্কুলে পড়ে না প্রাইভেট স্কুলে পড়ে? সভা চুপ, কেউ কিছু বলছেন না। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার আমার ছেলে মেয়েরা সরকারি এল. পি., এম. ই., হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। তখন প্রশিক্ষক মহাশয় আমার খুব প্রশংসা করেছিলেন। কথাগুলো এই জন্যই বললাম, ব্যতিক্রম আমি সব জায়গায়। তারপর শুক্লবৈদ্যজি আমার জীবনের সব দিক নিয়ে সভায় বক্তব্য রাখলেন, উনার মত বক্তা বলেই বলা সম্ভব। শেষে বললেন আপনি 'ব্যতিক্রমী' বটে। সভার কাজ শেষ।
তারপর এলো 31 শে আগস্ট 2015 ইং আমার কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার দিন। কি বলবো গ্রামবাসীরা যে কাজটি করলেন তা অবিশ্বাস্য। আমার ডাকা সভার চেয়ে বড় সভা করে সকলকে বুঝিয়ে দিলেন 40 বৎসর পূর্বে যাদের পড়ালেখার বালাই ছিল না, সভ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত অবস্থা তাদের ছিল না আজ সেই গ্রাম কোথায় দাঁড়িয়ে! সরকারি মানপত্র ছাড়াও ব্যক্তিগত ভাবে অনেকে মানপত্র এবং অজস্র উপাধিতে ভূষিত করলেন আমায় দিলেন নানা উপহার। সভায় ছিলেন আইরংমারা তথা বরাকের গর্ব পরিমল শুক্লবৈদ্যজি, অফিস অথরিটি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এলাকার মুরুব্বীবৃন্দ, জনসাধারণ, প্রাক্তন এবং বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ। উপস্থিত গন্যমান্যরা প্রশংসায় আমাকে ভাসিয়ে দিলেন। আমি নির্ধারিত আসনে বসে চোখের জল ফেলছিলাম আনন্দে। শেষে শুক্লবৈদ্যজি আমার জীবনের নানা দিক, সফল জীবন, সামাজিক চিন্তাধারা, স্কুল গঠন ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বলে বক্তব্য শেষ করলেন।
সভার কাজ ছল ছল চোখে শেষ হলো। আমার জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম বিদায় যে এত করুন। প্রায় তিন শতাধিক গ্রামবাসী এবং ছাত্র ছাত্রী মিছিল করে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন।
বিভিন্ন স্কুলে সংবর্ধনা, পেয়েছি ব্লক পর্যায়ের, 5 সেপ্টেম্বর 2018 ইং শিক্ষক দিবসে জেলা গ্রন্থাগারে জেলা ভিত্তিক সম্মাননা পেয়েছি। আমার কর্মজীবন নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।