নদী, চিল ও সমীরণ

ঝুমুর পান্ডে
প্রতাপ : অনলাইন-২৪ ]

 । ঝুমুর পান্ডে ।
 
নদীর উপর এক চক্কর, দুই চক্কর, তিন চক্কর দিতে দিতে সাঁই করে নেমে এসে মাছ টাকে ধরে ফেলল চিলটা। চিল না চিলনি কে জানে? যেই হোক। সমীরণ কি আর অতশত জানে না বোঝে! একবার সমীরণের ছোট্ট ঘরের পাশে যে অর্জুন গাছটা ছিল তাতে এক চিলনির সংসার ছিল। ছানা পিনা নিয়ে থাকতো। তাদের উপস্থিতির টের পেত সমীরণ। শেষে একদিন কারা কেটে ফেলল গাছটাকে। গাছ কাটলে ভীষণ কষ্ট হয় সমীরণের। ভীষণ! চিলনিটা তারপর ওর বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কোথায় গেল কে জানে! নদীর ওপর দুটো নৌকাও এদিক-ওদিক হচ্ছে। তার মানে মাছ ধরছে। সামনে নদীর ব্রিজটা বুক চিতিয়ে মানুষ গাড়ি সব পার করছে। লোকে বলে বরাক ব্রিজ। এই কিছুদিন আগে একজন সুন্দরী কন্যা এই ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে পড়ল। মাছ তোলার নৌকাটা তুলে আনল! কিন্তু তখন ধড়টা আছে প্রাণটা শেষ। কাদের বাড়ির মেয়ে ছিল? কোথায় ছিল ওর ঘরবাড়িই বা কে জানে? এরকম অনেক লোকজন অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আসে এখানে মরতে। ছাত্র-ছাত্রী বলো, রিক্সাওয়ালা বলো আর কলেজের প্রফেসর। এই তো দু বছর আগে এক বিরাট ব্যবসায়ীও ঝাঁপ দিয়ে মরল। এখান থেকে একবার লম্ফ দিলে আর কাউকে এখন অব্দি বাঁচতে দেখে নি সমীরণ। এজন্য হয়তো এত দূর দুরান্ত থেকে এরা আসে এখানে প্রাণ দিতে। চিলটা বোধ হয় এখন মাছটাকে নিয়ে কোথাও বসে খাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকায় সমীরণ। না - দেখা যাচ্ছে না। না, - তবে বোধ হয় ওর বাচ্চা কাচ্চার জন্য নিয়ে গেল। এখানে এই নদীটার পাড়ে হিজল জারুল কদম ছাতিম শিরিষ মিলে বেশ কয়েকটা গাছ জড়াজড়ি করে আছে। এককালে নাকি এই নদীতে স্টিমার চলত। তারপর নদী ভরাট হল। বন্ধ হয়ে গেল স্টিমার চলাচল। এসব সবই সমীরণের শোনা কথা। যেমন শুনেছে, সেই কোন যুগে নাকি ভূমিকম্পে নদী দিক পরিবর্তন করেছে। কত আনোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। চড়কের শিব দুর্গা যাচ্ছে, সঙ্গে নন্দি ভৃঙ্গী! ছোটবেলায় এই সব দলের পেছনে পেছনে ঘুরত সমীরণ। নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে একটা টুকটুকি গেল। লাল টুকটুক শাড়ি পরা একটা বউ নদীর দিকে চেয়ে চেয়ে গেল। বোধহয় নতুন বিয়ে হয়েছে। বাপের বাড়ির কথা বোধহয় ভাবতে ভাবতে গেল। না, - আরো অন্য কিছু? থাক সমীরণের অতশত জেনে লাভ কি? আকাশের দিকে তাকাল। বাহ! কি সুন্দর নীল আর সাদা সাদা মেঘ। একটু দূরে একজন এসে বসলো। কাঁধের কাপড়ের ব্যাগটাও রাখল। এমা ব্রিজটার কার্নিশ ঘেঁষে একটা ছেলে ঝুকে আছে। ঝাঁপ দেবে নাকি? পিঠে বোধ হয় ব্যাগ। এত দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। কেন যে এরা এমন করে! এই যে সমীরণের কত রকম দুঃখ জ্বালা, কই ও তো এইরকম মরার কথা কোনদিনও ভাবে না। এই তো কিছুক্ষণ আগে নিজেই লেবার অফিসের উঠোন না সিঁড়ি অবধি গিয়ে কি অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলো। আজকের রুজিটাও নষ্ট হলো। প্রায় ছ শো টাকা। তবু কি ওর একবারও মরার কথা মনে এলো? না। এলো না। সমীরণ বাঁচতে চায়। হ্যাঁ, সমীরণ মরতে চায় না। সকালে সবিতা মাস্টারনি দিদির বাড়ি কাজে গেছিল। কাজ শুরুও করেছিল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক উঠোনের ঘাস বেছে ছিল। তারপর গাছের ডাল কাটল তিন-চারটে। হ্যাঁ, তারপর যেই ওগুলো ফেলতে যাবে বিজু দাদার ফোন।
- তুই এখন কই? 
- কেনে? 
- কস না? 
- কামো। 
- তাড়াতাড়ি আয়। 
- কই? 
- লেবার অফিসও। ম্যাডাম আইসন।
- তে?
- তানে ধরা লাগবো।
- তোমরা যাও। আমি আইরাম।
- না আইলে এক টাকাও পাইতায় না।
অতএব কি আর করা। মাস্টারনি দিদির ঘরের কাজ ছেড়ে যেতে হলো। গিয়ে দেখে অফিসের সামনে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছে। অটো ভাড়া, বাস ভাড়া দিয়ে কাশিপুর, সোনাই, বাঁশকান্দি, শিলকুড়ি অনেক জায়গা থেকে লোক এসেছে। এদের সবার কাছ থেকেই ম্যাডাম নামক প্রাণী এক হাজার করে টাকা নিয়েছিল সার্টিফিকেট দেবে বলে। তার মানে পাঁচ ছয় লাখ টাকা তুলেছিল! তারপর সেই সার্টিফিকেটের কি হলো কে জানে? 
সার্টিফিকেট তো আর আসে না। ছুটতে ছুটতে আরও দুশো টাকা বেরিয়ে গেল সমীরণের। মাস্টারনি দিদি শুনে বলেছিলেন কিসের সার্টিফিকেট? 
- অও যে আমরা কাম কাজ করি? 
- তে - তোরা সার্টিফিকেট পাইয়া কিতা করতে? 
সমীরণ চিন্তায় পড়েছিল। সত্যি সার্টিফিকেট দিয়ে কি করবে? তবু যাই হোক সার্টিফিকেট তো সার্টিফিকেট। নিজের কাছে তো পাঠশালা পাশেরও সার্টিফিকেট নাই। 
মাস্টারনি দিদি আবার বলেছিলেন 'তোরার বয়স তো সবের চল্লিশ পার। কারোর পঞ্চাশ। তোরা তো কোনও চাকরিও পাইতে না।' এই ওদের ইউনিয়ন লিডার বিজুই সব গন্ডগোল করেছিল। সার্টিফিকেটের কথা তো বিজুই বলেছিল। ওই তো ওদের নিয়ে, সেদিন অনেকে বলছে এই বিজুও নাকি টাকার বখরা পেয়েছে। একবার ওই যে দুই নম্বরী মানুষটা কি যেন নাম, ওর ড্রাইভার বলেছিল শুধু একটা ব্যাগ এদিক থেকে ওদিকে করলেই টাকাই টাকা, হাজার হাজার টাকা। সমীরণ রাজি হয়নি। আকাশের দিকে তাকাল এখন সমীরণ! একটা নয় দুটো চিল উড়ছে। আরে ছেলেটা কোথায় গেল? যে ব্রিজ থেকে নীচের দিকে ঝুকে ছিল। পড়ে গেল নাকি? না, পড়ে গেলে চেঁচামেচি হত। ওই তো শান্ত নদী। আরও শান্ত মনে নাও বাইছে এক শান্ত মাঝি। সমীরণের যদি একটা নৌকা থাকতো নৌকা নিয়ে চলে যেতো অনেক অনেক দূরে। মাছ ধরত বাচা, লাচো, পাবদা সব নদীর মাছ। লারিয়া উঠলে ফেলে দিত। লারিয়া মাছ নাকি গু খায়। এইজন্য অনেকে খায়না। সমীরণও খায় না। এই বিজু লিডার লারিয়া মাছ খায়। একদিন দেখেছে ওকে নিয়ে যেতে। যাক, যার যার রুচি। এই বিজু লিডারের ইউনিয়নে বছরে ওরা সবাই তিনশো টাকা করে চাঁদা দেয়। আগে এক দুবার মিছিলেও গেছে। এখন আর এসব মানে মিছিল ফিছিল করে না বিজু লিডার। সমীরণকেও কাজ বাদ দিয়ে আর যেতে হয় না। তো এই বিজু লিডারই বলেছিল পনের দিনের ট্রেনিং, সবাই পনের হাজার করে টাকা পাবে আর সঙ্গে সার্টিফিকেট। শত শত মানুষ জড়ো হতো। সবারই প্রায় গাড়ি ভাড়া দিয়ে, নিজের খেয়ে খরচ হতো শ দেড়েক। সরকারের কোন স্কিম ছিল কে জানে! আজ বছর ঘুরে গেল দৌড়তে দৌড়তে পনের হাজার কি এক টাকাও পেল না সমীরণ। সমীরণ কেন কেউই পেল না। কবে পাবে কে জানে! হুস- হাস করে কয়েকটা গাড়ি গেল। আজকাল কত কিসিমের যে গাড়ি। সব গাড়ির নামও জানে না সমীরণ। এখানে মেয়ে-বউরা বারুণীর সময় তেল সিঁদুর দেয়। একবার বাবার সঙ্গে সিদ্ধেশ্বরের বারোনি মেলায় গিয়ে হারিয়ে গেছিল সমীরণ। বাবা গেছিল মাছ ধরার জাল কিনতে। আরেকবার তো শিলকুড়ির মেলায় গিয়ে....। জারুল গাছে কয়েকটা বক এসে বসল! কী সুন্দর নাদুস-নুদুস বকগুলো। মনে হচ্ছে কোনও দূর দেশ থেকে এসেছে। রাস্তা দিয়ে গান গেয়ে গেয়ে যাচ্ছে সেই লোকটা....
এ দেহ গাছ মায়ায় ভরা,
তাতে কত ফুলের শোভা গো
মায়া ছাড়ো মায়া ছাড়ো বলে কান্দে
হায়রে মনের কোকিলে ......
এমনি গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়ায় লোকটা। প্রতিটি পাড়া এমনকি গলি গলি ঘুরে কিন্তু কারওর কাছ থেকে কিছুই নেয় না। গান শুনলে সবাই একবার বেরিয়ে দেখে। লোকটার গানে কেমন একটা যেন জাদু আছে। লোকটা কারওর দিকে তাকায়ও না। শুধু গান গেয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটে ..... মায়া পাখি বসত করে ..... দেহের মাঝে গো .....
শিরীষ গাছের নিচে কে জানি এসে দাঁড়াল । লম্বা কালো মতন একটা লোক। হাতের বাঁশটা রাখল। আগের লোকটা কোথায় গেল? যাক যেখানে ইচ্ছে। সমীরণের কি? একটা বাচ্চা ছেলে পিঠে স্কুলের ব্যাগ। সাথে কেউ নেই। ছেলেটা কি স্কুল পালিয়ে এলো? কে জানে! সমীরণও এক দুই মাস স্কুলে গেছিল। না, - পিঠে ব্যাগ ছিল না। কিন্তু মাস্টার বাবুর কথা, পড়া কিছুই মাথায় ঢুকতো না। ছেলেরাও ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত। শেষে পড়াশোনা ছেড়ে দেয় তবে একবার খেলায় সব পুরস্কার তো সমীরনই পেয়েছিল! তো ... হ্যাঁ, লেবার অফিসে গেল তো সমীরণ। ম্যাডাম এসেছেন জেনে। সঙ্গের শত শত লোকেরাও হাজির। কিন্তু মজার কথা এত জনের মধ্যে একজনও সাহস করল না ম্যাডামের রুমে ঢুকে বলার যে আমাদের এক হাজার টাকার সার্টিফিকেট কোথায়?
- তুমি যাও।
- তুমি যাও।
- তুমি যাও। তুমি? তুমি? তুমি? 
কেউ দু পা গিয়ে ফিরে এলো। কেউ চার পা, কেউ দশ পা। বিশ পা। সমীরণ তো বুকে ঢিপঢিপ শব্দ নিয়ে সিঁড়ি অব্দি চলে গেছিল। কিন্তু আর পা চলল না। বুকে তখন ধক ধক এত বেড়ে গেল। আর এগোতে পারল না। তারপর যে যার পথ ধরল। আজ মাস্টারনির বাড়ির কাজটাও গেল। ছশো টাকা লস । ধুর। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। নদীটার দিকে আবার তাকালো সমীরণ। নৌকাগুলো একটাও নেই। কোথায় গেল এরা? কে জানে! এখন জলটা অনেক নীচে। ওই কিছুদিন আগে তো কি প্রলয় দেখাল নদীটা। কত কিছু যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ভাসাল । হায় রে। জল মানুষের দোতলা ছুঁয়ে ফেলল। খাওয়ার জল নেই। খাওয়া নেই মানুষের। কারেন্ট নেই। আরও কতকিছু ছিল না। সমীরণ তখন বউ বাচ্চা নিয়ে ইস্কুল ঘরে। কতজন এসে তখন খিচুড়ি খাওয়াত। জল বিস্কুট দিত। ফটো তুলত। কখনও বা নেতা গুছের কেউ। হেলিকপ্টারে মিনিস্টার আসত! আর .... যাক সেসব কথাবার্তা। কিন্তু সমীরণ নদীর ভেতর পড়ে গেল কি করে? ও তো গাছের নীচে বসে ছিল। নৌকা দুটোকে দেখছেনা। শুধু চিলগুলো উড়ছে। নদীটা ওকে কখনও প্রেমিকার মতো জড়িয়ে ধরছে। কখনও মায়ের মত স্নান করিয়ে দিচ্ছে। চারিদিকে ভাসছে কত ফুল। আহা রে! সাঁতার কাটছে কত রুপালি, সোনালি মাছেরা। আকাশ জুড়ে উড়ছে কত পাখি। ফুল ভর্তি একটা নৌকাও মাঝি ছাড়া হেলে দুলে চলছে। ওর উপর বসে আছে একটা নীল রঙের পাখি। না, - সমীরণ মরতে চায় না। দুহাত বাড়িয়ে দিল সমীরণ। হ্যাঁ, দা কামলা সমীরণ।.... আর আকাশ থেকে ঝরতে লাগল মুক্তোর দানার মত অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটারা! ঝরতেই থাকলো.....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১)

প্রচ্ছদ : শুভজিৎ পাল সম্পাদকীয় ......... বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব , দুর্গাপূজা। এই সময়টিতে বাঙালির প্রাণের মিলন , সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের...