কি একটা কাজে বহিরাজ্যে গিয়ে (ইউপি সম্ভবত) হাতে কিছু সময় বেঁচেছিল। কোথাও গিয়ে আশপাশ দেখার শখ বরাবরই। কিন্তু তাজমহল দেখার মত সময় হবে না, আগের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিরাপত্তা বিধি ও লাইন কাটতে কাটতেই একঘন্টা চলে যায়।
ছায়াময় গ্রাম্য! পথ থেকে বড় রাস্তায় উঠে এক ভটভটি (সেভেন সিটার) অটোঅলাকে জিজ্ঞেস করলাম তাজমহলের আগে কোন দর্শনীয় স্থান কিনা... সে হিন্দিতে বললো, "আছে, রথচটি"। বললাম, 'রথচটি'!, চলো, আমি যাবো। সে চালু হল, পথে লোক নিল, লোক নামালো। কিন্তু রাস্তাটি সংকীর্ণ! কেন বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু একটা গাড়িই চলাচলের সুবিধা আছে। মাঝে মাঝে সবুজ পাহাড়, লুঙা, নদী, আকাশের বিচিত্র রূপ দেখা দিচ্ছিল আর আমার শখ মিটছিল। যার লোভে আমি আশেপাশে ঘুরতাম। গাড়িতে স্বল্পদূরযাত্রী মেয়ে দুজন বাংলায় কথা বলছিল। ভাবছিলাম আমিও বাঙালি তাদের সাথে কথা বলব-- কিন্তু কী কথা বলবো!। তবু বললাম, তোমাদের ভাষাটা মিষ্টি। তাদের একজন বললো 'আপনার ভাষাটাও তেমনই'। বুঝলাম তারা প্রত্যুতপন্নমতি ও বাঙালি। ঠিক ঐসময় গাড়িঅলা বললো, "তিনশ টাকা ভাড়া দিন" । আমি দুশ টাকা দিলাম। সে বললো "ডাইশো দিজিয়ে"। বললাম বেশি হয়ে যাচ্ছে মনে হয়। সে বলল না বাবু যে জায়গায় যাচ্ছেন তিনহাজার নিয়ে আসতে পারবেন। বললাম কেন?- বললো 'ওধার বড়িয়া লটারী চিজ হ্যায়, সবকো ফায়দা হোতা হে'।
সবার ভাগ্য খুলে যায়! কতটুকু সত্যি জানিনা। দুপুর ঢলা সময়ে গাড়ি এসে এক পাড়াগাঁ দোকানের সামনে থামলো, যা অনেকটা ধাবার মতো। চানা, বিস্কিট, পাও, চা, চিপস, চিড়া-মুড়ি ডাল তেলও পাওয়া যায় । সামনে প্রশস্ত উঠান রয়েছে। দোকানী মহিলা বয়স্কা। আমি কিছু শুকনো খাবার ও জল নিলাম, জামাটা খুলে রেখে মাচায় হেলান দিয়ে বসলাম। কখন ঘুম চলে এল বুঝিনি। একটা সমবেত উল্লাসশব্দে ঘুম ভাঙল। দেখলাম দোকানের পাশে একটা খালি জায়গায় বড় টিভির অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। আমি তখন জামাটা খুঁজলাম। পাচ্ছি না। দোকানীকে (তখন বয়স্কার বদলে যুবক দোকানী) জিজ্ঞেস করলাম জামাটির কথা। সে বলল, কে ফেলে গেছে বুঝতে না পেরে দোকানের বাইরে ওদিকে ফেলে দিয়েছে। আমি সেদিকে গিয়ে দেখলাম বৃষ্টির জল গড়িয়ে রাঙামাটি হাল্কা ক্ষয়ে মুঠোহাত পাশে দুপাশে ঘাস নিয়ে যে অবতল পথ হয়, সে পথের পাশে অনাথ জামাটি আলুথালু পড়ে আছে। সেটি তুলে টাকাগুলি ঠিক আছে কিনা দেখছিলাম। দুটি কৌতুহলী যুবক এসে পাশে দাঁড়াল। বলল 'কেয়া হুয়া'। বললাম 'গরমিকে কারন কাপড়া উতারকে ওধার (আঙুল দিয়ে মাচানটা দেখালাম) বইঠ্যা থা, নিন্দ আগেয়াথা। তো দোকানবালানে নাসামঝকে মেরা কাপড়া ফেক দিয়া'। তখন দুজন দোকানীর কাছে গিয়ে বলল 'এইসা করনা ঠিক নেহী হুয়া। আভি পুলিশ বুলায়েঙে'। দোকানী আমার খালি গা দেখে ভুলটি বুঝলো। মাপ চাইলো। যুবক দুটিও কথা বাড়ালো না। আমাকে বলল 'কাহা যায়েগা', বললাম 'রথচটি'। তারা বলল 'চলো হামভি যারাহাহে, ওসতরফ। পয়দালসে যা সাক্তেহে। তাদের সাথে চললাম।
বেড়ানোর পথে দুই বন্ধু জুটলো। একজন আমার মতই খর্ব উজ্জ্বল কোঁকড়া চুল। অপরজন একটু মোটা লম্বা গালগোল হাল্কা দাঁড়ি শ্যমোজ্জ্বল রঙ। তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রথচটির মাঠে। এক জায়গায় এসে পরিবেশ দৃশ্যটা ভাল লাগায় বন্ধুদের বললাম 'একটু দাঁড়াও স্মৃতি ধরে রাখি।' একটা ছবি তুলবো। পেছনের দৃশ্যটা মিলিয়ে ফ্রন্ট ক্যামারা চালু করে সবার অবস্থান কেন্দ্রীকরন করতে করতে ভাল করে তাকাচ্ছিলাম। মোবাইল একবার এদিকে, আর একবার ওদিকে কাত করছিলাম, আবার তাকাচ্ছিলাম। চোখে ঝাপসা লাগছিল। কেন ঝাপসা লাগছে কি জানি, বড় করে তাকালাম। তারপর আরও বড় করে। কিন্তু এ কী! চোখ তো খুললো দৃশ্য স্পষ্ট হল, কিন্তু সামনের পরিবেশটা কোথায়? কোথায় রথচটির কোলাহল, কোথায় দুই সুজন, কোথায় মেলার মাঠে নামার প্রশস্ত ঢালু পথটা? কোথায় লটারীর পরিবেশ, ভাগ্য ফিরার কায়দাটা কোথায়? কিরকম? কিছুই তো নেই। চারদিকে শুধু আলোআঁধারি ভাব। দড়জা জানালার গুলগুলি দিয়ে ভোরের আলো আসছে। চারদিকে মশারী আমাকে ঘিরে আছে। একটু আগে কেউ বিছানা ছেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবে, কুঁচকানো চাদর ও মশারীর চিহ্ন দেখছি। আশেপাশে কেউ নেই। ওপরে মন্থর শব্দে পাখা ঘুরছে। কানে ঢুকছে প্রভাত পাখির কিচির মিচির ভাষা। আমি বিছানায়, স্বপ্নাচ্ছন্ন !!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন