![]() |
শতদল আচার্য |
। শতদল আচার্য ।
পৃথিবীর অনেক আন্দোলনের মত উনিশ মে ৬১ এক ইতিহাস তৈরী করে আছে। বড় বড় বিপ্লবের সাথে উনিশ মে-র মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বরাক উপত্যকার মতো ছোট ভূখন্ডের এই আন্দোলন আজ এক ইতিহাস। এই রক্তাক্ত ঘটনা অনেক আন্দোলন থেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে অনেক বড়। উনিশের মে'র আন্দোলন নিজের মাতৃভাষা বাঁচানোর আন্দোলন। অনেকের মতো এই বরাক উপত্যকাকে প্রান্তিক বলে চিহ্নিত করতে চাই না। যদিও এই উপত্যকা রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত হয়েছে বারবার তবুও এখানের এ প্রাণশক্তি সমস্ত বেড়াজালকে বারবার ভেঙেছে। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই বরাক উপত্যকায় ভাষার জন্য এত বড় আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা ঘটে গেল। বাংলা ভাষা রক্ষা করার জন্য এই যে বড় স্বতরস্ফূর্ত সংগ্রাম, তাও এক উদাহরণ হয়ে রয়ে গেল।
পৃথিবীর সব আন্দোলনে মেয়েদের এক বিরাট ভূমিকা থাকে। আমাদে স্বাধীনতা আন্দোলনে অপরিসীম সাহস ও শক্তি দিয়ে বীরাঙ্গনারা উজ্জ্বল ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। উনিশে মে'র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে করতে বার বারই এসব কথা মনে পড়ছিল। উনিশ মে ভাষা আন্দোলে দশজন তরুণ ও একজন তরুণী প্রাণ দিয়েছিলেন। সেই তরুণী পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনে প্রথম মহিলা শহিদ কমলা ভট্টাচার্য। শিলচর রেলস্টেশনে ১৯ মে ৬১-তে ১৬বছর বয়সে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে শহিদ হন। শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের বাবা রামরমন ভট্টাচার্য ও মাতা ছিলেন সুপ্রভাসিনী ভট্টাচার্য। শহিদ কমলা ভট্টাচার্য প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ [অপ্রেম] করে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শহিদ হওয়া্র কিছুদিন পর প্রবেশিকা পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হয়। শহিদ কমলা ভট্টাচার্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে কমলা ছিলেন তৃতীয় বোন।
ভাষার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলন তথা বেশি সংখ্যায় এই বরাক উপত্যকা ছাড়া কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। উনিশে মে আন্দোলনের ফলে বরাক উপত্যকায় ভাষ সংস্কৃতি ফিরে আসে। এই সাথে বাংলাভাষাও সরকারি স্বীকৃতি পায় তবুও অলিখিত ভাষা আক্রমণের চোরাস্রোত বারবারই নেমে এসেছিল। চোরাগুপ্তা আক্রমণ এলেও প্রতিবারই প্রতিহত হয়ে টিকে আছে ভাষা-সংস্কৃতি। ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন ফর্মে এখনও চলছে। বরাক উপত্যকার উনিশে মে'র ভাষা আন্দোলন বরাক উপত্যকার মানুষের চেতনায় এক আলোড়ন তুলেছিল। সেই দিনের আন্দোলনে শিলচর রেল স্টেশনে সকাল থেকে প্রচুর তরুণ-তরুণীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। রেল স্টেশনে রেল লাইনে বসে পুরো চত্বর বার বার শ্লোগানে মুখর করে রেখেছিলেন। আলো পাল চৌধুরী, শেলী রায়, চামেলী কর, তারামণি দত্ত, বেবী পুরকায়স্থ, গায়ত্রী বিশ্বাস, বীমা দেব, বেলা কর ও আরোও অনেকে।
উনিশে মে ৬১ তে, শিলচর রেলস্টেশনে মহিলা সত্যাগ্রহীদের উপর পুলিশ অনেক অত্যাচার করেছিল। কমলা দাস, আশারাণি দত্ত, শেফালী চক্রবর্তী, ভারতী চক্রবর্তীকে পুলিশ লাথি ও বন্দুক দিয়ে আঘাত করেছিল। শেফালী চক্রবর্তী লাঠির আঘাতে সজ্ঞাহীন হয়ে গর্তে পড়ে গিয়েছিলেন। কোন এক সত্যাগ্রহী দেখে তাকে তুলে নিয়ে আসেন। পরে দীর্ঘদিন হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেন। সেদিন গুলি চালনার পর বিধায়ক জ্যোৎস্না চন্দ পুলিশের সাথে বাক্-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এই ঘটনার পর শিলচরের বিধায়ক জ্যোৎস্না চন্দ পরিষদ দলনেতার অনুমতি ছাড়া বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এতে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এদিকে আহত সত্যাগ্রহীদেরকে ডাঃ কল্যাণী মিশ্র চিকিৎসা করেছিলেন।
উনিশ মে'র আন্দোলনে বিভিন্ন ভাবে মেয়েদের বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৯৬১-র ১৯শে মে'র সকালবেলা থেকে ছাত্রীরা রেললাইন দখল করে বসেছিলেন। একদল ছাত্রছাত্রীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেত, তারপর অন্য দল এসে সেই জায়গাটা ভরে দিতেন। উনিশের আন্দোলনে মেয়েদের যে অপরিসীম ভূমিকা ছিল তা এই ছোট প্রবন্ধে তুলে ধরা অসম্ভব। তবুও উনিশ মে'র ইতিহাস যেটুকু লেখা হয়েছে, কোন জায়গায় আলাদা করে বীরাঙ্গনাদের কথা লেখা হয়নি। এই প্রবন্ধে উনিশের ইতিহাসে শুধু বীরাঙ্গনা দের নাম তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।
উনিশ মে'র গুলি চালনার পর আন্দোলন আরো জোরদার হয়েছিল। অন্যভাবে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হয়ে গেল। উনিশ মে গুলি চালানোর পর আরও বেশি সংখ্যক মানুষ আন্দোলনে জড়িয়ে গেলেন।
৮ জুন ১৯৬১-র সকালে সংগ্রাম পরিষদ সত্যাগ্রহীরা সরকারের অনেক অফিস দখল করে নিলো। ডেপুটি ডিরেক্টর, সাপ্লাই, ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসে সত্যাগ্রহীরা ঢুকে পড়েছিলেন। (সূত্র: মুখের ভাষা বুকের রুধির অমিতাভচৌধুরী) অফিসবাবুরা অফিসে এসে পুলিশ মিলিটারিকে জানালে, বিভিন্ন অফিসে পুলিশরা যেতে থাকেন। পুলিশ মিলিটারি দীপ্তি ভরদ্বাজ নামে এক মহিলা সত্যাগ্রহীকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে গ্রেপ্তার করেছিল। দীপ্তি ভরদ্বাজের সাথে আরোও দশজন মহিলা সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। করিমগঞ্জে সেদিন হাকিম অফিস দখল করেন সত্যাগ্রহী মীরা কর। শিলচরে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের অফিসার চেয়ার দখল করেন সন্ধ্যা রায়চৌধুরী (শেলী রায়)। (সূত্র : ১৯শে'র স্মৃতি কথা: সনৎ কুমার কৈরী) পরে একে একে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া শিলচরে জজ সাহেবের চেয়ার দখল করেন সত্যাগ্রহী গোপা দত্ত। এদিনের এই অফিস দখল করা কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষ আদালত প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে অযৌক্তিক আইন আনার অপরাধে বিমল প্রসাদ চালিহাকে শাস্তি প্রদান করেন। দুই ঘন্টা ব্যাপী বিচার চলার শেষে সত্যাগ্রহী গোপা দত্ত বিচার করেন মুখ্যমন্ত্রীর এবং শাস্তি প্রদান করেন।
সেসময় আদালত কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে পুলিশ সুপার তথা বিভিন্ন পুলিশ কর্তারা ঘটনা দেখেন। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর গোপা দত্ত নিজের ইচ্ছায় আদালত থেকে বাইরে আসার পর পুলিশ সেই সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে। এইসব ঘটনা কিন্তু সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিলো।
এরকম অজস্র ঘটনাতে আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা অক্ষয় গাঁথা হয়ে আছে। আমার এই লেখায় শুধু রেখাপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। আরোও অনেক ঘটনা নিয়ে ভরে আছে এই আন্দোলনের ইতিহাস। কিছু তো এখনও লেখা হয়ে উঠেনি, কোনদিন হয়ে উঠবে হয়তো। সময়ের সাথে হারিয়েছে কত ঘটনা। অজস্র মহিলা সত্যাগ্রহীদের অংশ গ্রহণে আন্দোলন সার্থকতা পেয়েছিলো। এর ফলে আজও আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন