। পুষ্পিতা দাস ।
ও- মা দুটো তো প্রায় বেজেই গেলো।
আমি তো এখনো রেডি হইনি। আজও আদ্যা আবার রাগ করবে। বলেছিল - ঠিক দুটোয় রেডি থাকবি কিন্তু।
অদিতি বিড়বিড় করছিল। ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে উঠলো।
--
উমাদিদি, দেখবে গো কে এসেছে? দরজা খুলে উমাদি উত্তর দিল -- দিদি, আর্যাদিদি গো।
--
এসে গেছি। এ-ই তো জানতাম - রেডি হোসনি তো -- তুই টাইমে রেডি
হয়ে যাবি,
সেটা হয়!
--
সব তো টাইম ধরেই করলাম রে। কোনদিকে যে সময় চলে যায়। তবে চিন্তা
করিস না। তুই এসে গেছিস,
এখন আমার স্পিডও বেড়ে যাবে।
--
লাগবে না, সময় নিয়ে কর তো।
পুজোর দিনগুলিতেও নিজেকে একটু ফ্রি রাখতে পারলি না?
--
কী করব বল। আমার ঘরের ওরা তো বাইরের খাবার খেতেই চায় না। তার
উপর এখন পুজোর সময়,
একটু ভালোমন্দ নাহলে হয়? তাই একটু দেরি হয়ে গেলো। তুই বোস। ঠাণ্ডাটুকু খা। আমি রেডি হচ্ছি।
--
বললাম যে তাড়াহুড়ো করতে হবে না। তুই আমার পাশে এসে বোস তো।
দুজন মিলে একটু গল্প করি।
--
সে কী রে! তুই তো বলেছিলি তুই আর আমি একসাথে পুজো দেখবো।
--
যাবি? মাকে প্রণাম করবি? কিচ্ছু চাইবি মার কাছে?
--
হ্যাঁ চাইব তো, সব সময়ই চাই।
--
কী চাস?
--
সবার জন্য সুখ-শান্তি।
--
আর তোর নিজের জন্য?
--
সবার সুখেই আমার সুখ রে।
--
হয়েছে, আর বড় বড় কথা বলতে
হবে না। নিজের জন্য ভাবার সময় আছে তোর? তোর হয়তো মনেই নেই যে একসময় কত ভালো ছিলি তুই পড়াশুনায়। কী সুন্দর আঁকতিস, গান করতিস। একটিবারের জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলি
না। ওরা বললো ওরা চায় না ওদের বাড়ির বউ বাইরে কাজ করুক আর তুইও মেনে নিলি!
--
ছাড় তো এসব কথা, এখন এসব ভেবে লাভ কী?
--
কে বলেছে লাভ নেই? Better late than never. জব জাগো তভি সবেরা।
--
হয়েছে এবার? এবার রেডি হয়ে নিই?
--
আরে বোস না। কী দেখতে যাবি বলতো? মাকে না মায়ের ভক্তের ঢলকে? ভক্তেরা নিজেদের প্রার্থনাটুকু সেরে নিক। আমরা নাহয় একটু দেরি করেই গেলাম। মা
একসাথে কত প্রার্থনা মঞ্জুর করবে বল তো? কেউ চাইবে শান্তি,
কেউ টাকা পয়সা, কেউ চাকরি,
কেউ আবার মানস করে সন্তান চাইবে, কেউবা পুত্রসন্তান।
--
এভাবে কেনো বলছিস, পুত্রসন্তান?
--
তুই এসব বুঝবি না। তোর সন্তানও আছে তাও আবার পুত্রসন্তান।
--
কেনো বুঝবো না? কী যে ভাবিস আমাকে! মনে আছে রে আমার, কৃষ্ণানুর জন্মের পর সবাই কীভাবে অর্ণবকে বলেছিল -- মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু, ছেলে হয়েছে। শেলের মতো বিধেছিল রে কথাটা আমার বুকে।
আচ্ছা ছাড় এসব কথা। এবার তুই
বল তো,
তুই যে তোর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এলি, একটিবারের জন্যও তো বললি না কী হয়েছিল। এবার কিন্তু বলতেই হবে।
--
হ্যাঁ আজ সব বলবো বলেই তো একটু সময় নিয়ে তোর সাথে বসলাম।
তুই তো জানিস,
আমার বিয়েতে মা-বাবার সেরকম মত ছিল না। আমার দিকে তাকিয়েই
......। তাঁরাই
শিখিয়েছিলেন অন্যায়ের সাথে আপোস না করতে। তাই তো নিজেকে আটকাতে পারি না অন্যায়
দেখলে। আর সেটাই মেনে নিতে পারেনি পার্থিবের পরিবার। আমাদের পাড়ায় একটি বাড়িতে
প্রায়শই চিৎকার-চেঁচামেচি লেগেই থাকত। পরিবারের বড় ছেলের বউকে নিয়ে। কারন ছিল বউটির পরিবারের আর্থিক অবস্থান।
ঝামেলা ধীরে ধীরে বউটির উপর শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আমি সহ্য করতে
পারিনি। পুলিশে খবর দিয়েছিলাম। এর ভিত্তিতেই পুলিশ তদারকি করতে এসেছিল। তাই আমি
সবার কাছে শত্রু হয়ে উঠলাম। এদিকে আমার পরিবারে যা ঘটল, তা যদি তোকে বলি..... একদিন দেখলাম - আমার বড় জ্যা খুব
কাঁদছে -- ভয় পেয়ে গেলাম,
কারণ সে প্রেগন্যান্ট -- কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে
পারলাম যে তাঁদের এবারেও নাকি কন্যাসন্তান আসতে চলেছে, যা আমার ভাসুরমশাই চান না, কারণ তাঁদের আগের সন্তানটিও মেয়ে। তাই এবারের সন্তানটিকে উনি এবর্ট করাতে
চান। পরিবারের সবাই ব্যাপারটা জেনেও চুপ করেছিল। আমি আবার গর্জে উঠলাম। খুব কষ্ট
হয়েছি ভেবে,
এমন পরিবারে আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছিলাম। আমার প্রতিবাদে
ঘরের অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পার্থিবও বললো এটা নাকি তাঁদের নিজেদের
ব্যাপার,
আমি কেনো নাক গলাব। তুই ভাবতে পারিস! তাই চলে এলাম।
--
হুম বুঝলাম। মনটা ভারি হয়ে গেলো রে।
--
তোকে আর মন ভারি করতে হবে না। এবার অল্প কিছু খেয়ে রেডি
হয়ে নে। বেরোব।
--
এখন কোথায় যাবি? তিনটে বেজে গেলো। এই সময় তো প্যান্ডেলগুলোও ঝিমিয়ে পড়বে।
--
এখনই তো বেরোনোর সময়। চারটের টাইম দিয়েছে ওখান থেকে।
--
মানে? কী বলছিস তুই? চারটের সময় কী?
--
এত সিরিয়াস হওয়ার কিচ্ছু নেই রে বাবা। 'শান্তির নীড়' বৃদ্ধাশ্রমে যাব তুই আর আমি।
--
কী বললি? তুই যেন আমার
মনের কথা পড়ে ফেলেছিস রে। আমিও এবারের পুজোটা এভাবেই কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু
মনের কথা মনেই রয়ে গিয়েছিল। তাহলে চল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে।
ঠিক তখনই নিউজ চ্যানেলে পুজোর খবরের ফাঁকে ব্রেকিং নিউজ – “শ্রীভূমির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বারো বছরের শিশুকন্যা ধর্ষিতা মহাষ্টমীর সকালে।“ হঠাৎ করে যেন আদ্যা-অদিতির সমস্ত উৎসাহ মুহূর্তে মলিন হয়ে গেলো। তবুও একে অপরকে সামলে নিয়ে চলল ওরা নিজেদের মতো করে পুজোর আনন্দ নিতে। বৃদ্ধাশ্রমের সবার আশীর্বাদ নিয়ে ফিরছে ওরা, কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু সেই নির্যাতিতার কথা। কেমন আছে সেই শিশুটি, তার মা-বাবার অবস্থাই বা কী। নীরবতা ভেঙে অদিতি প্রস্তাব দিলো - চল না আর্যা নবমীতে আমরা 'নবজীবন' অনাথ আশ্রমে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসি। আর্য্যও রাজি। কিন্তু মনের ভেতরের চাপা কষ্ট যেন কিছুতেই কম হচ্ছে না। পথে একটি প্যান্ডেলে ঢুকে মৃন্ময়ীর দিকে তাকাতেই দুজনের চোখ ভরে এলো। যেন কত কথা আছে তাঁদের, মাকে বলার। দুজনের মন একই সুরে মা কে যেন বলতে চাইছে -- এমন ধরাতে সত্যিই কী আসো মা তুমি? এ ধরা কী তোমার যোগ্য? আর যদি সত্যিই তুমি আসো, তবে শুধু প্যান্ডেলে নয়, শুধু মন্দিরে নয় মা, প্রতিটি মানুষের মননে সেজে ওঠো তুমি, চেতনায় জেগে ওঠো তুমি অসুরিবিনাশিনী হয়ে। তোমার আসা তো শুধু উৎসবে সকলকে মাতিয়ে দিতে নয় মা, বরং তুমি আসো প্রতিটি নারীকে তাঁর প্রকৃত সত্তাকে চেনাতে, আর প্রতিটি পুরুষকে নারীর মাতৃসত্তাকে। তাই যদি তুমি এসেছ মা, জেগে থেকো তুমি নিরন্তর এ ধরার বুকে চৈতন্যময়ী হয়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন