![]() |
অসিত চক্রবর্তী |
উনিশে মে একটি তারিখ মাত্র নয়, একটি দিন। সে দিনটি শুধুমাত্র একটি দিনই নয় - ইতিহাস। প্রত্যেক মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের কাছে এক ঐতিহাসিক দিন। কেননা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য এই দিনটি এক বলিদান দিবস। আমি এই দিবসটিকে "শহীদ" দিবস বলবো না। বলবো না দুটি কারণে। প্রথমতঃ এটি আরবি শব্দ, যে ভাষাকে ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সে রক্তের দাগ এখনো টাটকা, গাঢ় লাল। কালো হয়ে যায়নি। সেই রাজাকাররা আজ আবার বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আবার বাঙালিদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। যেন ঠিক পহেলগাঁও, পরিচয় জিজ্ঞেস করে বাঙালি হিন্দু নিধন। পাকসেনারা সেদিন যেভাবে খুঁজে খুঁজে হিন্দু পাড়ায় হামলা চালিয়েছিল আজ পঞ্চান্ন বছর পর তারই পুনরাবৃত্তি চলছে। আজ আবার ভারত শত্রু-রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ এর বাংলা অর্থ আমাদের জন্য আপত্তিকর। এর বাংলা অর্থ হচ্ছে - শহীদ হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করে মৃত্যুবরণ করেন।কেউ নিজ ধর্মের রাস্তায় মৃত্যু বরণ করলে আমার কিংবা কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সে রাস্তাটা যদি আমার শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করে। আমার বেঁচে থাকার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমি মানবো কেন? অন্যদিকে ভাষা শহীদরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়াটা আল্লাহর রাস্তা নয়। ইসলাম ধর্মের কোথাও সে নির্দেশ নেই। সুতরাং 'শহীদ' শব্দের প্রয়োগ ভাষার জন্য বলিদান কারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তাই আমি ১৯শে মে তারিখে যারা প্রাণ বলিদান দিয়েছেন তাঁদের শহীদ বলবো না।
১৯ শে মে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি, এই দুটি আত্মবলিদান দিবসের প্রেক্ষাপট এক। উনিশের রক্ত ঝরাতে হয়েছিল অসমিয়া ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সে ভাষাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আসামে এখনও প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হচ্ছেন বাঙালি। বিগত শতাব্দীর জনগণনায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের মাতৃভাষা অসমীয়া বলে সেন্সাসে নাম তুলেছেন। এই কারনে হঠাৎ করে আসামে অসমিয়া জনসংখ্যা বেড়ে গেলে সেন্সাস রিপোর্টে এই ঘটনাকে বলা হয়েছিল Biological miracle। সুত্র:- what ails in the Indian North East, B C Shukla ।
সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের উপর ভয় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হাতি দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে গোটা আসাম।
অনুরূপভাবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলেন বাঙালি। সেসময়ে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মোট ৬ কোটি ৯০ লক্ষ। বাংলাভাষী জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। অর্থাৎ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হচ্ছেন বাঙালি। কিন্তু জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা পুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জিন্নার চোখে চোখ রেখে সেদিন (১৯৪৮, ২৩মে) বলেছিলেন - সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ব্যবহৃত ভাষাই কোনদেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। প্রথমবার তিনি আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন - I know sir, that Bengali is a provincial language, but, so far our state is concerned, it is the language of the majority of the people of the state and it stands on a different footing. Out of six crores and ninty lakhs of people inhabiting this State, four crores and forty lakhs of people speak the Bengali language. So, Sir what should be the state language of the state of Pakistan? The state language of the state should be the state language which is used by the majority of the people of the state........ ।
গণপরিষদের এই সভায় উপস্থিত সদস্য ৭৯ এর মধ্যে পূর্ববঙ্গের সদস্য ছিলেন ৪৪। কিন্তু তিনজন মাত্র, ভূপেন্দ্র নাথ, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায় ও বিধায়ক প্রেমহরি ছাড়া আর কেউ এই প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস করেননি। তাই বিপক্ষের শক্তির কাছে এই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
২১শের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পাকসেনাদের মদত জুগিয়েছিল বাংলাদেশের বৃহৎ সংখ্যক মুসলমানেরা। অনুরূপভাবে ১৯শের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে উগ্র অসমীয়া ভাষিক জাতীয়তাবাদীদের মদত জুগিয়েছিল মৌলবাদী মুসলমানেরাই। হাইলাকান্দি আলগাপুরের অসমীয়া ভাষার বলিদান বেদী তার প্রমাণ।
৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচয় জেনে পাকসেনারা হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালাতো। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পরিচয় আদায় করতে এক থেকে দশ বলতে আজ্ঞা করত। যেমন পহেলগাঁও-এ কলমা পরতে বলেছিল। ৭১ -এ পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের প্যান্ট খুলে পরিচয় বের করা হত। সেই অর্থে উনিশ এবং একুশের সংকীর্ণতার লেভেল একই ছিল। অন্যদিকে ১৯ এবং ২১শের বিশ্বাসঘাতকদের মুখ এবং মুখোস ছিল একই।
পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ বা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অসমীয়া ভাষা সাহিত্যের বিকাশের জন্য প্রাণাতিপাত করেছেন কিন্তু আজকেও অসমীয়া সাহিত্যিকদের তাদের অবদান স্বীকার করতে অনিহা। অসম সাহিত্য সভার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এইসব স্থাপয়িতাদের কোন নিদর্শন নেই। অনুরূপভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আজ উপেক্ষিত। তার জমিজমা আজ শত্রু সম্পত্তি। বাংলার প্রবাদপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি ভাঙচুর করছে বাংলাদেশের বাংলাদেশ ।
সাম্প্রতিক আসাম, ভাষিক বিবাদ ভুলে একই ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। বরাক ব্রহ্মপুত্রের নৈকট্যতা বাড়ছে। একদিন যারা নেতাজি, রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে কালিলেপন করেছিলো আজ সেই আসামে রবীন্দ্রনাথ নেতাজির মূর্তি স্থাপন হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। বরাকে লাচিত, চিলারায় দিবস পালিত হচ্ছে। উনিশের বলিদান কারীদের স্মরণ করছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু বাঙালির বাংলাদেশে আজ বাংলা নেই। আছে বাংলাদেশী বাংলা। বাংলা পিসি-মাসি হারিয়ে ফুফুর আতিশয্যে ধুঁকছে বাংলাদেশ। জল হারিয়ে পানিতে ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারালো বাঙালি হিন্দু, জমিজমা বিষয় সম্পত্তি হারালো বাঙালি হিন্দু, ইজ্জত হারালো বাঙালি হিন্দুর মা-বোন, কিন্তু স্বাধীনতার পর তারা বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই পেলনা। বরঞ্চ আসামে ১৯শের আত্মবলিদান অনেকটাই সফলতার মুখ দেখেছে। বাংলাদেশে যেখানে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙচুর হয়েছে, একদিন আসামে নেতাজি, কবিগুরুর মূর্তিতে কালিমা লেপন করা হয়েছে -- সেখানে আসামে আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি, রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হয়েছে। ১৯শের আত্মবলিদানকারীদের স্মরণ করছেন মুখ্যমন্ত্রী। বরাকের সরকারী ভাষা বাংলা স্বমর্য্যাদায় আসীন। তাই ২১শে ব্যর্থ হলেও ইতিহাসের আলোয় ১৯ স্বমহিমায় উজ্জ্বলতর ।
তাই অনেকে ১৯ ও ২১ কে এককরে দেখেছেন। কবির কবিতায় --
বরাক আমার অমর একুশ, বরাক উনিশে মে
বরাক আমার পুষ্প নদী, রৌদ্রে ভেসেছে।
.........
এপাড়ে গাঙ ওপারে গাঙ, মধ্যে মায়ের বুক
উনিশ একুশ বাকপ্রতিমা, রক্তে রাঙা শোক ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন