রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র জয়ন্তী

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘…… বাঁচি যত কাল

তোমাদেরই মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই, 

তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল 

নব নব সংগীতের কুসুন ফোটাই

হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায় 

ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।।’

বিশ্বজনীন একাত্মতার এমন আকুল আর্তির সত্যিই কি কোনো প্রয়োজন ছিল? আত্মসংযম আর মূর্ত বিনয়ের প্রতীক বিশ্বকবির এ স্বীকারোক্তিই আজ যুগ যুগান্ত ধরে উত্তরসূরিদের পাথেয় হয়ে আছে। সুনিপুণ হাতের গাঁথা মালা কি কোনোদিন শুকোতে পারে? সে সংগীতের কুসুম আবহমান কাল ধরে হয়ে আছে স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক। এর তুলনা আগেও কোনোদিন ছিল না আর পরেও কোনোদিন হবে না। এ ফুলের তুলনা শুধু নিজেই। কিন্তু এত কিছুর পরেও পাঠকের দরবারে দরবারে পৌঁছানোর এই যে আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার এই যে বাসনা এতেই তাঁর মহানুভবতার পরিচয়। জীবন্তে কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেও তাই অবলীলায় কবি বলতে পারেন -

‘বলেছি যে কথা করেছি যে কাজ

আমার সে নয়, সবার সে আজ...।’

বিশ্বজনীনতার মূর্ত প্রতীক বিশ্বকবির নিজের ভাষায় -

‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া

সব দেশে মোর দেশ আছে আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া

পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই

তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই

কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই

সন্ধান লব বুঝিয়া

ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়

তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।’ 

কিন্তু যাদের নিয়ে বিশ্বকবির প্রত্যাশা তাদের দায়িত্ববোধ আজ কতখানি? বিদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আজ কতটুকু তা ভেবে দেখার আগে একটিবার ঘরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করা দরকার। ফি বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজনে আমরা বদ্ধপরিকর। এ উদ্যোগ সর্বাংশে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কার উদ্দেশে এত আড়ম্বর? তিনি কে? কোথায় তাঁর বিচরণ? কবি রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি কিংবা গুরুদেব অভিধায় সম্বোধন করা হয় - তিনি গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন - তিনি ব্রিটিশের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। সমাবেশে সমাবেশে এসব চর্বিতচর্বণই করা হয়ে থাকে সর্বত্র। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আজ আমাদের কাছে কতটুকু?

এতটুকুতেই গর্বে আমাদের বুক প্রশস্ত হয়ে যায়। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই আমরা অতি সহজে অনুধাবন করতে পারি সেই বিশালতা যা যুগ যুগ ধরে আমাদের দিয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের গরিমা, স্বতন্ত্র এক পরিচয়। সৌভাগ্য আমাদের যে আমাদেরই অতি আপন গৃহে জন্মেছিলেন এমন একজন মহাপুরুষ যাঁর দান মহাসাগরের মতো। জীবনের এমন কোনো মোড় নেই যেখানে নেই তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। আমরা আজ রবীন্দ্রনাথের নাম নিয়ে হইচই করি, রবীন্দ্র পূজার জন্য মণ্ডপ নির্মাণও করি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেন রবীন্দ্রনাথ - তা পুরোপুরি জানার আগ্রহ আমাদের কম। নিজেদের দেশেই তাঁর ধ্যানধারণা ও সাধনার প্রচারে আমরা অক্ষম। মোদ্দা কথা যা, তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যে বাংলা ভাষার চর্চা করেছেন, ভাষার পুষ্টিসাধন করেছেন সেই বাংলা ভাষার উপরই আমাদের মমত্ব, আমাদের দায়বদ্ধতা কতখানি? শুদ্ধ চর্চার মাধ্যমে ক;জন আমরা প্রাণ খুলে বলি - ‘মোদের গরব মোদের ভাষা, আ মরি বাংলা ভাষা’? ২৫শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ, ২১শে ফেব্রুয়ারি আর বড়জোর ১৯শে মে। এর বাইরে ভাষা জননীর কথা আমরা মনে রাখি ক’দিন ?

রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল তাঁর রচনা ছড়িয়ে যাবে বিশ্বময়। এ বাসনা সবারই থাকে। কিন্তু বিশ্বময় ছড়ানোর আগে আমাদের নিজেদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে তার প্রকৃত রসাস্বাদনের দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই। রবীন্দ্রনাথ উচ্চ পর্যায়ের কবি এবং স্বভাবতই সর্বসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে একটা ভ্রান্ত ধারণা প্রচিলত আছে। সে ভুল ভাঙা আবশ্যক। রবীন্দ্রনাথ আমাদের একান্ত আপন। তিনি দূরের বলে যাদের ধারণা - তাঁর রচনার কথা দূরে থাক, তাঁর মনের পরিচয়ও তারা পাননি। ত্রিশ বছরের যুবক, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ এমন অনুমান তখনই করেছিলেন। তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন - ‘সরলহৃদয় চাষাভুসোরা আমাকে কী ভুলই জানে। আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না।’

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে অনুষ্ঠান হচ্ছে। দায়সারা ভাবে দু-একজনকে ডেকে নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ানো হচ্ছে। বক্তৃতার আগেই সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে বক্তব্য যেন সংক্ষিপ্ত হয়। বক্তা কী বলবন সেটা বিচার্য নয়, কতটা বলবেন সেটা বিচার্য। অগুনতি মানুষজন আসছেন নাচ গান দেখতে। শিল্পীরা সবাই ব্যস্ত নিজেদের তুলে ধরতে। রবীন্দ্রনাথের কথা তারা একটিবারও চিন্তার মধ্যে আনছেন না। একজন বক্তা মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জীবনের পরিচিতি তুলে ধরতে চাইছেন অতি কষ্টে। শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ একজন মন্তব্য করে উঠল - ‘আমরা লেকচার শুনতে আসিনি। রবীন্দ্রনাথের কথা অনেক শুনেছি।’ 

বড় মায়া হয় এদের দেখে, এদের কথা ভেবে। এরাই আজকের শিক্ষিত, আধুনিক মননশীলতার প্রতীক। এরাই বোধহয় বলতে পারেন - ‘রবীন্দ্রনাথকে আমরা জানি’। মরুভূমির প্রতিটি বালুকণা, সিন্ধুর প্রতিটি জলবিন্দু গুনে শেষ করা কি একটি জীবনের কাজ? রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ জানা কি এক জীবনে সম্ভব? অথচ এরা কেমন অবলীলায় বলতে পারেন - আমরা রবীন্দ্রনাথকে জানি। এদের জন্যই বোধ করি কবি লিখে গেছেন -

‘...... আমাতে তোমার প্রয়োজন

শিথিল হয়েছে, তাই মূল্য মোর করিছ হরণ,

দিতেছ ললাট পটে বর্জনের ছাপ। কিন্তু জানি,

তোমার অবজ্ঞা মোরে পারে না ফেলিতে দূরে টানি।

তব প্রয়োজন হতে অতিরিক্ত যে মানুষ তারে 

দিতে হবে চরম সম্মান তব শেষ নমস্কারে...।’

ভাষাজননীর প্রতি একটুখানি ভালোবাসা, ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষায় একটু সচেষ্টতা, শুদ্ধ করে দুটি শব্দ বলা কিংবা লেখা - এতেই যে কত তৃপ্তি তা সাধক ছাড়া কে আর বুঝবে? গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনও বুঝি এতেই সার্থক। নাহলে শুধু আড়ম্বর আর চটকে কি পূজা হয়?

‘...যতই উঠে হাসি, 

ঘরে যতই বাজে বাঁশি, 

ওগো, যতই গৃহ সাজাই আয়োজনে,

যেন তোমায় ঘরে হয়নি আনা

সে কথা রয় মনে...।’

ঘরে আনতে গিয়ে একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের শুধু নাচ গানের রসে মজলেই কি সব পাওয়া যায়? একটু অনুশীলন, একটু সাধনা করলেই বুঝতে পারা যায় রবীন্দ্রনাথের কী সে মাণিক্য ভাণ্ডার যা আমরা পেয়ে গেছি উত্তরাধিকার সূত্রে। পেতে যেখানে কষ্ট করতে হয়নি সেখানে শুধুমাত্র ভোগ করতে যাওয়ার কষ্ট স্বীকারে কেন এত দ্বিধা? জীবনের চলার পথের প্রতিটি মোড়ে তিনি রেখে গেছেন অজস্র ধারণা, অজস্র আকর। শুধু কুড়িয়ে নেওয়া। জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, ধর্ম-রাজনীতি, সমাজ-সংসার, প্রেম-ভালোবাসা কোথায় নেই তাঁর অবদান? রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভা এবং বিচিত্র কাব্য সম্ভার সুস্থ সরল, আত্মসম্মানশীল রসিক সমাজের অনুধাবনযোগ্য, সাধারণের আওতার মধ্যে। আমরা যদি কোনোদিন সুস্থ সবল জাতি হতে পারি তবে তা হবে একমাত্র রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করেই। এই একটি মাত্র আদর্শ আজকের জাতি ও জাতির চরিত্র গঠনে চিরকালীন পাথেয়। শুধু রবীন্দ্র সাহিত্য নয়, রবীন্দ্রনাথের আত্মসম্মানবোধ এবং মনুষ্যত্ব ও মর্যাদাবোধের আদর্শই হতে পারে আমাদের প্রকৃত চিন্তাধারা।

তা বলে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন কোনোভাবেই বিরূপ সমালোচনার যোগ্য হতে পারে না। অন্তত এমন করে হলেও তো আমরা বেঁচে আছি তাঁর সান্নিধ্যে। বলার উদ্দেশ্য হল - যতটুকু করছি, তা যদি শুদ্ধ বোধে করার চেষ্টা করি তাতেই মিলবে প্রকৃত আনন্দ। সার্থকতার আনন্দ। সে আনন্দ আত্মিক, হৃদয়ের। চটুল রসাস্বাদনের পরিবর্তে প্রকৃত পূজায় মেতে উঠুক সমাজ। কবিগুরুর আশার অনুরূপ -

‘সে-আমারে কে চিনেছ মর্ত্যকায়ায়?

কখনো স্মরিতে যদি হয় মন,

ডেকো না, ডেকো না সভা, এসো এ ছায়ায়

যেথা এই চৈত্রের শালবন।’ 

[প্রতাপ ঃ অনলাইন-৪]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : অনলাইন-২৯

  এই সময়টা আমার নয়           । শৈলেন দাস । এই সময়টা আমার নয় মেঘে বাদলে জুটি কালবৈশাখী ঝড়ে তছনছ সেই ঘর যেখানে আমি থাকি। পুরো কবিতাটি পড়ু...