![]() |
সুনীল রায় |
( লেখক ১৯৬১ র ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় সত্যাগ্রহী ও ১৯৭২ -৭৩ এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র যুব সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক তথা ত্রিপাক্ষিক শিলং চুক্তিতে একজন স্বাক্ষর কারি )
*মে মাস* এলেই মনে হয় এটা ভাষা আন্দোলনের মাস। মাতৃ ভাষার তথা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে দেবার ইতিহাসের মাস। ১৯৬১ র মে মাস বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবর্ষের মাস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবর্ষে দেওয়া শ্রদ্ধার্ঘ্য, এর ফুল গুলো তখনও সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় নি । ১৯৬১ সনে একাদশ ভাষা শহিদ, শতাধিক আহত দের রক্তে রবীন্দ্রনাথ, ঋষি বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন, শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের তথা বিশ্বের মাতৃভাষা বাংলা ভাষার বেদী মূলে বুকের রক্ত ও আত্ম বলিদান দিয়ে ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেল শিলচরের ভাষা সেনানীরা। স্বাধীন ভারতের সব চাইতে কলঙ্কের দিন - যে এই প্রথম স্বাধীন ভারতের সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র নিরপরাধ সম্পূর্ণ শান্তি পূর্ণ ভাবে শিলচর স্টেশন নিকট বর্তী দাবদাহে তপ্ত রেল লাইনে ৫ জৈষ্ঠ্যের (১৩৬৮ বঙ্গাব্দ ) দগ্ধ হয়ে অবস্থান রত সত্যাগ্রহীদের বর্বরের মতো ঠান্ডা মাথায় খুন করার কলঙ্কিত ইতিহাস। পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সেদিনই শিলচরে সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আসা কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য্যকে হত্যা করেছিল আসাম পুলিশ। আর একজন ছাত্র শচীন্দ্র পালকেও হত্যা করেছিল। তিনিও সে বছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। সঙ্গে আরও নয় জনকে হত্যা করেছিল পুলিশ। এমন পরিস্থিতে হত্যা করা হয়েছিল, যখন রাজ্যে এমন একজন মুখ্যমন্ত্রী যিনি কিনা কাছাড় জেলারই (বর্তমান বরাক উপত্যকার বদরপুর কেন্দ্র) বাঙালিদের ভোটে জেতা নির্বাচিত বিধায়ক বিমলা প্রসাদ চালিহার শাসনে। ইতিহাসে লিখা আরও একটি কলঙ্কিত অধ্যায় রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরুর উপস্থিতিতে সেদিন শিলচরে বর্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছিল। বরাক থেকে একমাত্র নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী চালীহার শাসনই রাজ্যে হাজার হাজার বঙ্গ ভাষী গণহত্যার শিকার হয়েছিল ও বহু বাঙালিকে রাজ্য ছাড়া হতে হয়েছিল। এই চলিহার শাসনেই ১৯৬০ সনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ না হয়েও সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে অসমিয়া ভাষাকে বহুভাষিক রাজ্যের রাজ্য ভাষা হিসেবে আইন পাশ করা হয়েছিল। সেদিনও আসামে সরকারি হিসেবে বঙ্গ ভাষীর সংখ্যা ৩০% ছিলো আজও তাই। উল্লেখ্য ১৯৩০ ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অবিভক্ত সমগ্র আসামের শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরাজি অথবা বাংলা মাধ্যম বিষয় ইংরাজি অথবা ইংরাজি মাধ্যম বিষয় বাংলা। অথবা ইংরাজি ছাড়া কোন ভারতীয় ভাষা। ১৯৩০ এর দশকে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার বিষয় তথা মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আসামে বাঙালির সংখ্যা ৩০% দেখানো হলেও, বাস্তবে রাজ্যে বঙ্গ ভাষীর সংখ্যা অনেক বেশী। কারণ বিতারণের ভয়ে অনেক মুসলমান ও আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা পাবার আশায় অনেক হিন্দু বাঙালি নিজেদের পরিচয় অসমিয়া লিখতে বাধ্য হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ চা শ্রমিক যাদের বেশীর ভাগের আদি নিবাস পশ্চিম বঙ্গের পুরুলিয়া, বর্ধমান, ছোটনাগপুর ও বর্তমান ঝাড়খন্ড তথা এক সময়ের মল্ল ভূমি বা মানভূমি এবং যাদের মাতৃভাষা সাঁওতালি, মুর্মু ইত্যাদি হলেও প্রাচীণ কাল থেকে পরস্পরের যোগাযোগের ভাষা বাংলা ভাষা তখনও ছিলো এখনও আছে। আর মল্ল (কুস্তি) ভূমির যেমন বীরত্বের ইতিহাস আছে তেমনি মাতৃভাষা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসও আছে।
স্বাধীন চেতা বাঙালি মল্ল রাজাদের ইতিহাসের শুরু সপ্তম শতাব্দির শেষ দশকে। কুস্তি বিশারদ বলেই রাজাদের উপাধি মল্ল। মল্ল রাজারা স্বাধীন চিন্তা ছাড়াও শিল্প কলায় ভারতের ইতিহাসে অভূত পূর্ব যোগদান রেখে গেছেন যার সাক্ষী আজও বহন করছে তাদের এক সময়ের রাজধানী পশ্চিম বঙ্গের বিষ্ণুপুরের মন্দির, মঠ ও প্রাসাদ, টেরাকোটা মাটি ও কাপড়ের শিল্প কলা এখনও বিশ্ব বিখ্যাত। (এই প্রতিবেদক সেখানে ভ্রমণ করে অভিভূত)। এই মল্ল রাজাদের ভৌগোলিক সীমানাই বর্তমান ইতিহাসে মানভূমি নামে পরিচিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎ মল্ল রাজাদের বা মানভূমির কথা বলার তাৎপর্য কি থাকতে পারে পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে। সে কথায়ই আসছি। আমরা প্রথম ভাষা আন্দোলন বলতে পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করি। এবং কাছাড় জেলার তথা বরাক উপত্যকার ১৯৬১, ১৯৭২, ১৯৮৬ এবং ১৯৯৬ এর ভাষা আন্দোলনের কথা আলোচনা করি। কিন্তু, মানভূমে যে বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৪৭ সন থেকে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছিল সে কথা বিস্মৃত। ইতিপুর্বে অন্যত্র দীর্ঘ নিবন্ধে আমি কিভাবে বাংলা ভাষা বিরোধী চক্রান্ত বিগত শতাধিক বছর থেকে চলছে এই সম্বন্ধে কিছুটা আলোক পাত করেছি। সেই আলোচনার সার সংক্ষেপ -- ইংরেজরা ১৭৫৭ সনে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত ও হত্যা করে যে বঙ্গ দেশ দখল করেছিল এর সীমা আজকের সম্পূর্ণ বঙ্গ, বিহার উড়িষ্যা ও ঝাড়খন্ড ছিল। ১৮২৬ থেকে ১৮৭৫ মধ্যে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলের ক্ষমতাও দখল করে বৃহত্তর বঙ্গ ভূমি গঠন করেছিল ইংরাজ। আধুনিক শিক্ষা শুরু হলে, ইংরেজির সঙ্গে যে বিষয় বা মাধ্যম হিসেবে দ্বিতীয় ভাষা ছিল সেটি ছিল বাংলা ভাষা, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড ও বঙ্গ সহ সম্পূর্ণ পূর্ব ভারতে। ১৯১২ সনে পাকা পাকি ভাবে বঙ্গ ভঙ্গ হলে বিহার ও উড়িষ্যা একটি প্রশাসনিক অঞ্চল এবং সিলেট সহ উত্তর পূর্ব আলাদা অঞ্চল। বাকি খন্ডিত বঙ্গ দেশ। ১৯৩০ এর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর বদান্যতায় আসামে বাংলা ভাষার সঙ্গে অসমিয়া ভাষাও মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাজনের সময় ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র আসামে গণ ভোট নামে প্রহসন করে আসাম থেকে সিলেট বিভাজন করা হয়। সেই গণ ভোট নামক প্রহসনে মানভূমির লক্ষ লক্ষ আদি বঙ্গ ভাষী চা শ্রমিককে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল ওরা আসামের স্থানীয় লোক নয় এই অজুহাতে। ভাগ্যের পরিহাস, নিজেদের ভাষিক সংখ্যা বেশী দেখাতে কারও দাবী ওরা আসামের স্থায়ী আদিবাসী অসমিয়া আর কারও দাবী ওরা হিন্দি ভাষী। প্রাণ বাঁচাতে উনারাও যেখানে যেমন তেমন সেই পরিচয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু, এই মানভূমির আদিবাসীরা ১৯৪৭ সন থেকে ব্যাপক আন্দোলন করার ফলেই বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের পুরুলিয়া জেলাকে বিহার থেকে কেটে পশ্চিম বঙ্গের জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল ১৯৫৬ সনে। ১৯৪৮ সনে অতুল্য ঘোষ, ভজহরি মাহাতো, চৈতন মাঝি প্রমুখ প্রায় চল্লিশ জন নেতা কংগ্রেস ত্যাগ করে "লোক সেবা সংঘ" গঠন করেছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলন করার জন্য। সেটিই ছিল বাংলা ভাষা সুরক্ষার প্রথম গণ আন্দোলন। হাজার হাজার সত্যাগ্রহী বার বার কারাবাস করে শেষে পুরুলিয়া জেলা বিহার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পশ্চিম বঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন সংগ্রামী জনতা। মান ভূমের আদি বাসীদের যাঁদের আত্মীয় স্বজন আসাম ও শ্রীহট্টের চা শ্রমিকরা তাদেরই আন্দোলনের ফসল পুরুলিয়া পশ্চিম বঙ্গে ১৯৫৬ সনে সংযুক্ত করন। আবার বিহার ভঙ্গ হয়ে ঝাড়খন্ড রাজ্যের জন্ম নভেম্বর ২০০০ সনে। ঝাড়খন্ড রাজ্য হওয়ায় হিন্দি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষাও রাজ্য ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। (উল্লেখ্য রাজ্যে প্রকৃত উর্দু ভাষী ও প্রকৃত হিন্দি ভাষী অত্যন্ত নগণ্য)। বিহার রাজ্যে বাংলা ভাষা রাজ্য ভাষা নয় সম্ভবত হিন্দির আগ্রাসনে কোন বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ও আর নেই। ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন করার সময় কোন ভাষাকে রাজ্যের একক ভাষা করার শর্ত ছিল -- কম করে সেই রাজ্যের ৭৫ শতাংশ লোক একই ভাষা ভাসীর হতে হবে। আসামের নেতারা আসামে রাজ্য ভাষা একমাত্র অসমিয়া করার জন্য আগেই শ্রীহট্ট বিভাজন মেনে নিয়েছিলেন। শ্রীহট্ট বিভাজনের পূর্বে আসামের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী ছিল বঙ্গ ভাষী এবং অসমিয়া ভাষা ভাষির দ্বিগুণ থেকেও বেশী। শ্রীহট্ট বিভাজিত হলেও মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% ছিল বঙ্গ ভাষী হয়তো ৪৫% অসমিয়া বাকি ১৫ % অন্য। এই অবস্থায় অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য ছিলো। আগেই উল্লেখ করেছি কি কারণে বহু বঙ্গ ভাষী হিন্দু মুসলমান নিজেদের পরিচয় অসমিয়া লিখেছেন। শুধু কি তাই, রাতারাতি বাংলা মাধ্যমের বহু বিদ্যালয়কে অসমিয়া করণ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৪৭ সনে গোয়াল পাড়া জেলায় বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় ছিল ২৫০ টি কিন্তু ১৯৫১ সনে সেটি কমে হয় ৩ টি। সুতারং ১৯৬০ এর বাঙালি বিদ্বেষ ও গণহত্যা কোন হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা ছিল না। ছিল সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত বাঙালি বিদ্বেষ চরিতার্থ করার প্রয়াস। ১৯৬১ সনে আসামে যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেটা শুধু কাছাড় জেলা বা বরাক উপত্যকায় সীমাবদ্ধ ছিল এমন নয়। সমগ্র ভাষিক সংখ্যালঘু অঞ্চল নাগা পাহাড় জেলা (বর্তমান নাগাল্যান্ড রাজ্য), লুসাই পাহাড় জেলা (বর্তমান মিজোরাম রাজ্য), খাশি জন্তিয়া জেলা ও গারো পাহাড় জেলা (বর্তমান মেঘালয় রাজ্য) ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি প্রধান অঞ্চল সর্বত্র আন্দোলনের প্রভাব ছিল। কারণ আন্দোলনের মূল দাবি ছিল --"বাংলা ভাষাকে রাজ্যের দ্বিতীয় রাজ্য ভাষার মর্যাদা প্রদান করতে হবে এবং অন্যান্য ভাষিক সংখ্যালঘুদের ভাষাকেও যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে"।
মানভূমির বঙ্গ ভাষীরা আন্দোলন করে অন্ততঃ পুরুলিয়া জেলাকে পশ্চিম বঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ২১ শে ফেব্রুয়ারি "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের" মর্যাদা পেয়েছ। কিন্তু, আসামে বাংলা ভাষা রাজ্য ভাষার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। আর্থিক সম্মাননা তথা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত ভাষা শহীদদের পরিবার ও ভাষা আন্দোলনে গুরুতর আহতরা বা তাঁদের পরিবার।
এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনার উদ্দেশ্য, এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে ১৯৬১ র ভাষা আন্দোলন আমাদের শুধু হারানোর ইতিহাস। আমরা শুধু এগারোটি তাজা প্রাণই হারাই নি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে আমাদেরকে আন্দোলন স্থগিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমাদের দাবীর প্রতি নূন্যতম ন্যায় না করে আমাদের হাতে বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা ভাষার স্বীকৃতি স্বরূপ ললিপপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা সে সময়ের ভাষা আন্দোলনকারী সংগঠন "কাছাড় জেলা গণ সংগ্রাম পরিষদ" এর নেতারা সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লিখিত ভাবে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে ছিলেন। সরকারি হিসাবেই ৩০% বঙ্গ ভাষাভাষী বাস করেন আসামে। অন্যদিকে ১০% কম ভাষিক সংখ্যালঘুদের ভাষা বড়ো ভাষাকে ন্যায় সঙ্গত ভাবে রাজ্য ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে যে সরকার সেই একই সরকার বাংলা ভাষাকে রাজ্য ভাষার স্বীকৃতি দিচ্ছে না। বরাক উপত্যকার বঙ্গ ভাষীদের বাদ দিলেও রাজ্যে আরও ২০% বঙ্গ ভাষী আছেন। একটি গণতান্ত্রিক সরকার এই ভাবে একটি ভাষিক গোষ্ঠিকে পদদলিত করে রেখেছে আজ প্রায় সত্তর বছর থেকে। রাজ্য ও দেশের বৌদ্ধিক সমাজ নিরব দর্শকের ভূমিকায়। নিরব দর্শকের ভূমিকায় ভাষিক সংখ্যালঘু কমিশন ও কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যের বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠি দ্বারা শহিদ স্বীকৃত ব্যক্তিদের শহীদের সম্মান ও আর্থিক সম্মাননা দিলেও বরাক উপত্যকা সহ রাজ্যের কোন বঙ্গ ভাষী শহিদকে সরকার আইনি স্বীকৃতি দেয়নি। উল্লেখ্য, মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি কাছাড় জেলার দেওয়া তথ্য ভিত্তি করে, ২৬ মার্চ ২০১৮ তারিখ রাজ্য বিধান সভায় বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষার ১৩ জন এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের একজন শহিদের নাম লিখিত ভাবে উল্লেখ করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু শহিদদেরকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে আর্থিক সম্মাননা দেয়নি। আর্থিক সম্মাননা দেয়নি ভাষা আন্দোলনে যাঁরা গুরুতর আহত হয়েছেন তাঁদের বা তাঁদের পরিবারকে। এই বঞ্চনার যন্ত্রণা থেকে আশু মুক্তিই কাম্য।
পরিশেষে বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের ও যাঁরা গুরুতর আহত হয়েছিলেন তাঁদের নাম উল্লেখ করে ও শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
*১৯৬১ সনের ১৯ মে ( ৫ ই জৈষ্ঠ্য ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ ) শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহিদ ও গুরুতর আহতরা* ----
*ভাষা শহিদ* --- কমলা ভট্টাচার্য্য, শচীন্দ্র পাল, হিতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল দে সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাই লাল নিয়োগী, তরণী দেবনাথ, চন্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।
*১৯ শে মে '৬১ শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলি, লাঠি, বয়নেট ও লাথির আঘাতে গুরুতর আহত ভাষা সেনানীরা*
গীতা দে, প্রদীপ কুমার দত্ত, মানিক মিয়া লস্কর, মনোরঞ্জন সরকার, নিশিতেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর, সন্তোষ চন্দ্র কীর্তনিয়া, রঞ্জিত সরকার, গবীন্দ্র চন্দ্র দাস, নীরদ চন্দ্র বর্মণ, রাম চন্দ্র দাস, অঞ্জলী রানী দেব, রেনুকণা সরকার, জিতেন্দ্র কুমার দেব, ছায়া রানী দেব, বীরেন্দ্র কুমার রায়, প্রদ্যুম্ন কুমার চক্রবর্তী, অনিল চন্দ্র দাস, ভূপেন্দ্র কুমার পাল, গৌরী বিশ্বাস, জ্যোতিষ কুমার ভট্টাচার্য্য, যামিনী মোহন নমঃশূদ্র, সুবিনয় ধর, শ্যামল কান্তি গুপ্ত, মতিলাল পাল, বিধান চন্দ্র রায়, দীপালি দে, হারান মন্ডল ও রজনী মালাকার।
*১৯ শে মে '৬১ করিমগঞ্জ রেল স্টেশনে যাঁরা লাঠি চার্জ ও বুটের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছিলেন* --- মায়া মিঞা চৌধুরী, কমলা রানী দাস, আশা রানী দত্ত, শেফালী চক্রবর্তী, সুখবিন্দ সেনগুপ্ত, বাবুল চন্দ্র রায়, ভারতী চক্রবর্তী, প্রীতি দস্তিদার, শিপ্রা চক্রবর্তী, সন্তোষ মজুমদার ও পুষ্পরানি কর্মকার।
*শিলচর রেল স্টেশনে আরও যাঁরা গুরুতর আহত হয়েছিলেন কিন্তু স্থানাভাবে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি* ---
পঙ্কজ বিশ্বাস, ঠাকুর চাঁদ শব্দকর, নিখিল চন্দ্র দেব, মঙ্গলা ভট্টাচার্য্য, পঙ্কজ পাল, জীবন কৃষ্ণ দাস, গোবিন্দ চন্দ্র দাস, তারাচরণ দেবনাথ, যামিনী নমঃশূদ্র, ললিত মোহন দেবনাথ ও হিরন্ময় মিত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন