। ড. কাত্যায়নী দত্ত চৌধুরী ।
জেন জি ও জেন আলফার সাথে আমাদের মিলিনিয়েলাদের বিস্তর ফারাক। কিন্তু ছেলেমেয়েদের টিচার গাইড হওয়ার সুবাদে এই ব্যবধান তো অতিক্রম করতেই হয়, দূরত্ব বেশি হলে মনের ঠিক কাছাকাছি পৌঁছনো যায় না। এইতো কিছুদিন আগের কথা, তখনো এই দফার পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যায়গুলো পড়ানো হয় নি। একজন জেন জি বললেন, " ম্যাডাম তুমি কান্তারা (সিনেমা) দেখেছো? কী অ্যানিমেশন দিয়েছে দেখার মতো!" আমার আগ্রহ হলো, জানতে চাইলাম, " এই সো কলড্ অ্যানিমেশন ছাড়া আর কী দেখলি?" ওর বর্ণনায় তিনটে বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেলো- প্রথমটা নিবিড় রহস্যময় জঙ্গল, দ্বিতীয় হচ্ছে দৈব শক্তি, তৃতীয় স্থানে মানুষ, যারা এই দুইয়ের সাথে মিশ্র সংযোগ স্থাপন করেছে। আমার মতো সিনেমা লোভী মানুষের তো আর তর সয় না, ভাবলাম দেখেই ফেলি। প্রথম পার্ট টা নেটফ্লিক্স থেকে প্রায় গিলে ফেললাম। যা আপাত দৃষ্টিতে বোধগম্য হলো, পরের দিন থেকে তা ক্লাসে ইমপ্লিমেন্ট করার পালা। মনে হলো যেন এক টুকরো বনের গল্প আমাদের জন্য অপেক্ষারত কতদিন।
বিষয় জৈব বৈচিত্র্য ও বনানী সংরক্ষণ বা বায়োডাইভার্সিটি এণ্ড কনসারভেশন। মানুষ যে জিনিস বিজ্ঞানের ভাষায় বুঝতে নারাজ , আশ্চর্য রকম ভাবে পৌরাণিক কাহিনি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। যে মানুষ প্রকৃতির বিনাশ করে, সে মানুষকেই আবার প্রকৃতি রক্ষণাবেক্ষণে অনায়াসে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
পৃথিবীর বনাঞ্চলের মাত্র দুই শতাংশ ভারতের অধিকারে ও পৃথিবীর জৈব বৈচিত্র্যের মোট আট শতাংশ এই দুই শতাংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আজও বিরাজমান। এই বৈচিত্র্যের জন্যই যুগে যুগে এই ভূমিতে এতো জনগোষ্ঠীর আসা আর যাওয়া, যুদ্ধ ও ব্যবসা, শিকার ও পর্যটন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে জানি, অথচ তা রক্ষনাবেক্ষণ করতে ততটা তৎপর নই। তাই তো পথে ঘাটে বেড়াতে গেলে চিপসের প্যাকেট, জলের বোতল যত্র তত্র ফেলতে আমরা কুন্ঠা বোধ করি না।
রাজা-বাদশা ও ইংরেজরা নিজেদের স্ট্যাটাস আপডেটের জন্য যে এককালে কত বাঘ মারলেন, খাদ্য শৃঙ্খল বিষয়ে জ্ঞানের অজ্ঞতা এই মূল্যবান জন্তুটিকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিলো। ধন্যবাদ সরকারের টাইগার প্রজেক্টকে যার জন্য বাঘের প্রজাতির সাংখ্যিক উন্নতি চোখে ধরা পড়ে।
এখন কান্তারার গল্পে আসা যাক। 'কান্তরা' হচ্ছে এক রহস্যাবৃত জঙ্গল, যাকে ঘিরে অলৌকিক - অলৌকিক গল্পের শেষ নেই। ২০২২ সালের চলচ্চিত্রটি কর্ণাটক ও কেরালার উপকূলীয় অঞ্চলের ৫০০০ বছর প্রাচীন ভুতা কোলার প্রেক্ষাপটে নির্মিত। ভুতা কোলা উপলক্ষে সুপ্রাচীন গল্প-গাঁথা-নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে যখন উপস্থাপন করা হয়, সেই মুহূর্তে দৈব শক্তি পৃথিবীতে নেমে আসেন এমন ধারণা বহু যুগ ধরে চলে আসছে, তখন বনের দেবতা পাঞ্জুরালি ও গুলিগা বনকে সুজলা সুফলা রাখার আশীর্বাদ প্রদান করেন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। বন সংলগ্ন উপজাতি সম্প্রদায় যখন তাদের দৈব শক্তির উপর সমর্পিত ও সেই বনের সৎ ও কর্মতৎপর ফরেস্ট অফিসার যখন বনের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তখনই বিজ্ঞান, আইন ব্যবস্থা ও ধর্মীয় রীতিনীতি এক সমান্তরাল রেখায় উপস্থাপিত হয়। এক কথায় এখানে পারস্পরিক লেনদেনটি - বনকে তুমি সংরক্ষণ করো, বনও তোমায় সুরক্ষা প্রদান করবে।
এক টুকরো বনের গল্পের শেষাংশে এসে বলতে হয় যে সেই হাজার বছর আগের মানব জাতি থেকে আমরা আজ জেন জি, জেন আলফা, বিটা, থিটা, ইটা, যাই হই না কেন, প্রকৃতিই আমাদের উৎসস্থল, এটা ভুললে চলবে না। ভুলে যাচ্ছি বলেই বিপদ আসন্ন, তাই রাসকিন বণ্ডের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়তলী থেকে মেঘ ভেঙে পড়ে, জীবনানন্দের ধানসিঁড়ির তীর প্লাবিত হয়, আর ঊনিশের শহর শিলচরে তাপমাত্রা বেড়েই চলে। সিনেমা শুধুই সিনেমা হয় না, কিছু সত্য, কিছু বর্তমান, কিছু ভবিষ্যৎ ও কিছু সম্ভাবনা। তুমি আমি শুধু প্রকৃতির অংশ মাত্র....আমাদের শুধু এটুকুই পরিচয়।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন