বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অন্তর্গত একটি গ্ৰাম হলো শ্রীকোনা লালমাটি। গ্ৰামটি শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই গ্ৰামে "নুনকুলি" নামে একটি পবিত্র তীর্থস্থান রয়েছে। যেখানে প্রতিবছর "শিব চতুর্দশীর" দিনে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। ভক্তের সমাবেশে ঐ দিন মেলাও বসে সেখানে। প্রসাদ হিসেবে খিচুড়ির আয়োজন করা হয়, কারণ অনেক দূর থেকে ভক্তবৃন্দরা এদিন পুজো দিতে আসে। এই স্থানটির "নুনকুলি" নামকরণের একটি কারণ আছে। সেটি হল এখানে একটি ছোট্ট পুকুর আছে যার জল তেতো (লবনাক্ত)। তাই স্থানীয় লোকজন এর "নুনকুলি" নামকরণ করেছেন। এছাড়াও এই পুকুরের জল ফুটন্ত ভাতের জলের মতো টগবগ টগবগ করে বলে এর আরেক নাম "বগবগি " কেউ কেউ আবার "বগবইকখা"ও বলে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে মানুষের সাড়া পেলে এর জল খুব জোর শব্দে টগবগ করে।
এই "নুনকুলি" বা বগবগিকে নিয়ে একটি কাহিনী আছে যা আমি আমার ঠাকুমা (গৌরমণি দাস) এর কাছ থেকে শুনেছি। সেটি হল এই যে, "আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে যখন আমার ঠাকুমা এই "নুনকুলি" পাহাড়ে লাকড়ি (জ্বালানি) আনতে যেতেন তখন স্থানীয় এক বাসিন্দার (ভোলন তন্তবায়) একটি হাতির বাচ্চা ঐ বগবগির জ্বলে পড়ে যায়। প্রথমে অল্প জল ভেবে এই হাতির শাবকটি ক্রীড়া করতে থাকে। পরে বাচ্চাটি যখন তলিয়ে যেতে থাকে তখন মা হাতিটি শাবকটিকে বাঁচাতে আসেন এবং ওরা দুজনেই এই বগবগির জলে তলিয়ে যান। এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় লোকেরা আর "নুনকুলির" জলে নামেন না এবং এই স্থানকে দেবস্থান ঘোষণা করেন। আর তখন থেকেই সবাই এখানে পুজো দিতে আসে। অনেকে দর্শন করতেও আসে এই স্থানটি।
নুনকুলির এক অলৌকিক মহিমা আছে। এখানে যাওয়ার পর এক আলাদা সদর্থক অনুভূতি হয়, ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধ পায় বাবা মহেশ্বরের কৃপায়। আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমার এই যৎসামান্য লেখনীর মাধ্যমে। আপনারা একবার হলেও এই স্থানটিতে এসে দর্শন করে যাবেন। শিলচর থেকে আসলে আই. এস.বি.টি পেরিয়ে কল্যাণী হসপিটাল ও শ্রীকোনা ও.এন.জি.সি. অতিক্রম করে ওভারব্রিজ এর বাঁদিকে একটি রাস্তা গিয়েছে। যার নাম শ্রীকোনা টি.ভি. টাওয়ার রোড। এই রাস্তা দিয়ে সোজা পথ ধরে হাঁটলে আসাম রাইফেলসের হেড কোয়ার্টার ও পাওয়ার গ্ৰিড অতিক্রম করে অসম্পূর্ণ নলেজ সিটি এবং কিছু ঝর্না পার হলেই আপনি পৌঁছে যাবেন নুনকুলি পাহাড়ে। আপনারা গাড়ি নিয়েও আসতে পারেন রাস্তা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই উন্নত। বদরপুর থেকে আসতে হলে শালচাপড়া অতিক্রম করে শ্রীকোনা ওভারব্রিজ থেকে নেমে ডাইন দিকে মোড় নিলে টি.ভি টাওয়ার রোড পেয়ে যাবেন। সেই রোড় ধরে সোজা গেলেই "নুনকুলি" পাহাড়ে পৌঁছে যাবেন অনায়াসে।
এই "নুনকুলি" পবিত্র স্থানের আশে-পাশের জনবসতি তেমন ঘন নয়। এছাড়া মহাদেবের কৃপায় এখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা বজায় আছে। এই গ্ৰামে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাড়া সব সম্প্রদায়ের মানুষই আছে। তবে যারা আছেন এই গ্ৰামে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ছেড়ে মোটামুটি সবাই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। এই গ্ৰামে সরকারি চাকুরিজীবী খুব কম। বেশীরভাগ মানুষই ব্যবসায়ী। মহাদেবের কৃপায় এখানে খুব বেশি সুপারি হয়। তাই সুপারি ব্যবসায়ী অধিক। সুপারির সঙ্গে পানের উৎপাদনও খুব ভালো হয়। একটি খাসিয়া পুঞ্জি আছে এই গ্ৰামে। তারা সপ্তাহের দুটি বাজারে গাড়ি বোঝাই করে কলা, পান, লেবু ও নানাবিধ জিনিস বিক্রী করে থাকেন। তাছাড়া শাকসবজি ও বাঁশের করুল যা দিয়ে হিড়ম্বা খুব ভালো তৈরি হয় ও চোঙা পিঠের বাঁশ (ডলু বাঁশ) এই গ্ৰাম থেকেই বেশি বিক্রি হয়। অনেকের বাড়িতে আবার বড় বড় পুকুরও আছে। সুতরাং মৎস্য উৎপাদনও খুব ভালো হয়। এছাড়া এই কয়েক বছর থেকে আমি দেখছি যে খুব বেশি পরিমাণে ফুল বেলপাতাও আমাদের গ্ৰাম থেকেই বিক্রি হচ্ছে। অনেক পাইকার আসেন এবং এখান থেকে ক্রয় করে শিলচর শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। কয়েকবছর আগে গ্ৰামটি এত উন্নত ছিল না। পাওয়ার গ্ৰিড ও আসাম রাইফেলসের হেড কোয়ার্টার এই গ্ৰামে আসার ফলে গ্ৰামটি অনেকটা উন্নত হয়েছে। এখন নলেজ সিটির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে এটি চালু হয়ে গেলে গ্ৰামে সোনালী যুগের সূচনা হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন