![]() |
মহুয়া চৌধুরী |
। মহুয়া চৌধুরী ।
মহাকালের নিরবধি পথ পরিক্রমায় মানব সভ্যতা সেই সুদূর অতীত থেকে কালে কালান্তরে বিভিন্ন উপাদানকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে। এই অন্তহীন যাত্রায় ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি একটি-অপরিহার্য উপাদান।
মানব শিশু জন্ম থেকে মাতৃনির্ভর। মাকে অনুসরণ করেই তার জীবনপথে চলার শুরু। তাই ভাষা শিক্ষাও সে তার মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। মুখের ভাষা এজন্যই আমাদের কাছে মাতৃভাষা।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। হাজার বছরের কালের পরিক্রমায় বাংলা ভাষা একটি নির্দিষ্ট রূপ গ্রহন করে বর্তমানে এক ঐতিহ্যময় ভাষায় পরিগণিত। সমগ্র বিশ্বের সভ্য সমাজে বাংলা এক বিশিষ্ট ভাষা রূপে সর্বজন স্বীকৃত।
মানব জীবনের স্বাভাবিক গতি বিভিম্ন ভাষিক গোষ্ঠীর মানুষ নানা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। এই নিরিখে অনেকেই বলে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলার প্রথম কুমারি, পূর্ববঙ্গ বাংলার দ্বিতীয় ভুবন এবং বাংলার তৃতীয় ভুবন হলো বরাক উপত্যকা।
১৯শে মে ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষার তৃতীয় ভুবন বরাক উপত্যকায় ভাষা সংগ্রামে গুলিতে নিহত হয়ে ভাষা শহিদ হলেন এগারো জন ভাষাপ্রেমী। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় আত্মবলিদান দেওয়া এঁরা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরনী মোহন দেবনাথ, সত্যেন্দ্র দেব, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও কানাইলাল নিয়োগী।
১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তাতে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর লোক। জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে বরাক উপত্যকার মানুষ প্রমান করে দিয়েছিলেন ঐক্য ও সাম্যের ক্ষেত্রে যে আমরা এক ও অভিন্ন। বাংলা ভাষার এই আন্দোলন তাই এই অঞ্চলের একতা ও সাম্যেরও এক অনন্য উদাহরণ। মানুষ জীবশ্রেষ্ঠ হওয়ার যে স্বীকৃতি লাভ করেছে তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলন। আবার অন্য দিকে মানুষের এক দমন ও নিপীড়নকারী চরিত্রেরও পরিচয় মেলে উনিশে মে-র গুলি চালনার ঘটনায়। মুখ ও মুখোশের, সাদা ও কালো নানা ধরনের চেহারাও প্রকট হয়েছে এই আন্দোলনে। উনিশে মে-র দিনটির গুলিতে নিহত এগারো জন-এর পাশাপাশি বহু তরুন তরুনী, নানা বয়সের লোকজন পুলিশের লাঠি চালনায় মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছেন, গুলি লেগে অনেকে আজীবন কষ্ট পেয়েছেন।
উনিশে মে-র একাদশ শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যেকে তাঁদের প্রতিও নিবেদন করছি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। এঁদের অনেকের নাম জানা গেলেও অনেকেই বিস্মৃতির আড়ালে বিলীন হয়ে গেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই মিশে আছেন বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ছোট বড় নানা শহিদ বেদীর প্রতিটি বালু কণায়। একথা বরাক উপত্যকাবাসী মানুষেরা নানা সময়ে অনুভব করতে পারেন। তাঁদের আত্মত্যাগের এই আন্দোলনের ফলেই আজ বরাক উপত্যকায় আমাদের মাতৃভাষা সরকারী স্বীকৃতি লাভ করেছে। আজ শুধু বরাক উপত্যকার মানুষ নয়, বিশ্বের যেখানে যত সচেতন বাংলাভাষী মানুষ রয়েছেন সবাই উনিশে মে'র ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করেন।
ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বিভিন্ন স্থানে উনিশে মে'র ভাষা শহিদ বেদী স্থাপন করা হয়েছে, ভাষা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে শিলচরের শ্যামাপ্রসাদ রোডে, বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ভাষা শহিদদের নামে।
১৯৯৫ সাল থেকে আবেদন জানানো হচ্ছে শিলচর রেল স্টেশনের নাম 'ভাষা শহিদ স্টেশন, শিলচর' করার জন্য। ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর প্রথমে আসাম সরকার এবং পরে ভারত সরকার তা অনুমোদন করেন। কিন্তু আজও এই নাম লিখা হয়নি - শূন্য বুকে দাঁড়িয়ে আছে রেল স্টেশনের তোরণ।
উনিশে মে দিনটি প্রতিবছর প্রভাতফেরী, ভাষা শহিদ স্টেশনে শ্রদ্ধার্ঘ, নিবেদন, শিলচর শ্মশান ঘাটে ভাষা শহিদ স্মৃতি ফলকে পুষ্প স্তবক অর্পন করার মাধ্যমে পালন করা হয়। পালন করা হয় বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় স্মৃতিচারণ, নানা প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে। নাচে, গানে, কবিতা পাঠে, আলপনা অঙ্কনে, আলাপে আলোচনায় দিনটি প্রতিটি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানে পালিত হয়। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় আত্মদানকারী সংগ্রামী এবং শহিদের কথা। বরাক উপত্যকার নানা স্থানে কৃষ্ণ চূড়ার রক্তিম পুষ্পের সমারোহে যেন ভাষা শহিদদের রক্তের অর্ঘ্য রচিত হয়।
মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মদানকারী ভাষা শহিদের স্মরণ এবং মননের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যেককে বাংলা ভাষার চর্চায় আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে গবেষণাধর্মী বিভিন্ন রচনায় ও কাজে প্রকাশ করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। মাতৃভাষা বাংলায় বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ইত্যাদির নাম ভাষা শহিদদের নামে রেখে তরুন প্রজন্মের মনে তাঁদের জন্য সম্মানের আসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা যেন সর্বোত ভাবেই আমাদের মাতৃভাষাকে জননী এবং জন্মভূমির মতো স্বর্গ থেকেও শ্রেয় এবং প্রিয় বলে অনুভব করতে পারি। এই শিক্ষায় প্রতিটি শিশুকে অতি ছোটবেলা থেকেই বড় করে তুলতে হবে।
মনে রাখতে হবে উনিশে মে আমাদের আত্মপরিচয়ের দিন। ভাষা শহিদের রক্তে স্নাত এই দিনটি ব্যথা বেদনার পাশাপাশি গৌরব এবং বৈভব অর্জনেরও দিন।
উনিশে মে-র একাদশ ভাষা শহিদ তোমাদের আমরা চিরকাল মনে রাখবো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন