। অসিত চক্রবর্তী ।
জানি, বলে লাভ নেই। লিখে লাভ নেই। যা লিখবো বা বলবো, তাতো সবার জানা। চুপ করে কিল হজম করছেন সবাই। কারণ, অভিযুক্ত তো নিজেই। আসামে বাংলার সর্বনাশ করছি আমরাই।
উনিশে মে'র আত্মবলিদানের লক্ষ্যবিন্দু ছিল মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেটা পেতে গিয়ে রক্ত দিতে হল। বরাকে সরকারি ভাষা পেল বাংলা। আমরা কি মাতৃভাষা বাংলায় পড়াচ্ছি সন্তানদের? আমরা কি মাতৃভাষা বাংলাকে বরাকে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুইজ হিসাবে ব্যবহার করছি? এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। আসামে বাংলার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে এই প্রশ্নেই।
বরাকে ব্যঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল। আর গজিয়ে উঠেছে মাদ্রাসা বা মক্তব। এই স্কুলগুলো আর যাই হোক বাংলা ভাষার পুষ্টি সাধন করতে তৈরি হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে বাঙলা ভাষার হাল হকিকত কেমন, তার চর্চা করে আমাদের তেমন লাভ নেই। সেখানেও বাংলা এবং বঙ্গসংস্কৃতি বিপন্ন। বরাকের বাংলা, বঙ্গসংস্কৃতি বা বাঙালিকে তারা কেউ রক্ষা করতে আসবে না। যা কিছু করনীয়,তা করতে হবে আমাদেরই। কিন্তু আমরা কিছুই করছি না। পাঠ্যপুস্তকে অসমিয়া শব্দ দেখলে ভ্রু কুঁচকাই। কোথাও অসমিয়া সাইনবোর্ড দেখলে কেউ কালি লাগিয়ে দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করি। অন্য ভাষার আগ্রাসন নিয়ে চায়ের আড্ডা গরম করি। ম্যামোরেনডাম দেই। ব্যস, এতটুকুই। এগুলো তো স্থায়ী সমাধান নয়। বরাকে একটির পর একটি বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ছাত্র সংখ্যার ঘাটতি, সে অশুভ সংকেতের ইঙ্গিতবাহী। তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণী ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলে ঝুঁকে পড়ায় ছাত্র সংখ্যার ও মেধাবী ছাত্রের আকাল পড়েছে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে। ছাত্ররা বাংলা না জানলে আগামী প্রজন্মে কে পড়বে বাংলা সংবাদপত্র, বাংলা ম্যাগাজিন। বাংলা সাহিত্য, গল্প, কবিতা? বর্তমান সরকার অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষা বাধ্যতামূলক করায় সে শেষ রক্ষা হয়েছে। নইলে অবস্থা আরও করুণ হতো। অন্য দেশ বা রাজ্যের সাহায্যের আশা এখানে বোকামি বৈ কিছু নয়। যা করতে হবে, আমাদেরকেই করতে হবে। অসম সরকারের করার কিছু নেই। পরমুখপ্রেক্ষীতা নয়। আমাদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমের স্কুলে আমাদেরকেই দিতে হবে। আমাদের সন্তানদের বাংলা সাহিত্যের পাঠক করতে হবে। তবেই বরাকের বাংলা সাহিত্য বাঁচবে।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফর্মি; আর্টসের এক নাটক "পিসিমা" দেখলাম। ঘরোয়া বিষয় নিয়ে বাংলা নাটকটি। অভিনয়ে বরাকের ছেলেরা। মঞ্চস্থ হল বরাকে কিন্তু হিন্দি-অসমিয়াতে। জিজ্ঞসাবাদে জানলাম বাংলা ভাষায় এক্সপ্রেশনের অসুবিধার দুর্বলতার জন্য নাটকটির ভাষান্তর করা হয়েছে। বরাকের ছেলেদের এহেন কান্ড কি লজ্জাকর নয়? এতো সিঁদুরে মেঘ।
করিমগঞ্জে গোস্বামী পদবিধারী একজন ডি সি অনেক বছর কাজ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছিলেন, বারবার বলা সত্ত্বেও সবাই ভুলে শুদ্ধে ইংরাজীতে দরখাস্ত করেন। তাদের কে বাংলায় লিখে আনতে বললে পুনরায় কাউকে বলে কয়ে সেই ইংরাজিতেই লিখে আনেন। তিনি বলেন, অফিসিয়াল কাজে বাংলা ব্যবহারের অধিকার তো আপনারা সঃগ্রামের দ্বারা অর্জন
করেছেন।
যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একাদশ শহিদ আত্মদান করলো, সে সাধনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কোথায়? মাতৃভাষাতে পড়াশোনা করলে আমার সন্তান সমৃদ্ধ হবে, তাতে আত্মবিশ্বাস কোথায়? নিজের ভাষা সংস্কৃতির প্রতি যাদের আত্মবিশ্বাস নেই। তাদের পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কি হতে পারে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন