![]() |
দীপক সেন গুপ্ত |
শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী, গণেশ দে থেকে শুরু করে রূপরাজ ভট্টাচার্য, বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য, কনকদীপ শর্মা পর্যন্ত সুবিস্তৃত যদি সরলরেখা আঁকি তবে দেখব এই সরল রেখায় অবস্থিত অজস্র বিন্দুতে দাঁড়িয়ে অসংখ্য গল্পকার বরাক উপত্যকার ‘গল্পবিশ্ব’ নির্মাণ করেছেন। অন্তহীন এই ‘নির্মাণ’ প্রক্রিয়ায় সময়ের বালুচরে সৃষ্ট সৌধ থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় দূর-দূরান্তের বিস্তৃত বঙ্গভুবন আলোকিত। ‘গল্পবিশ্ব’ নির্মাণের প্রক্রিয়ায় মূল বঙ্গভুবন থেকে নির্বাসিত এই ভূখণ্ড নীরব অভিমানে প্রজন্মান্তরের একাগ্র আন্তরিক সাধনায় এই উপত্যকার আলো হাওয়া রোদ মাখানো জীবন কথা উঠে এসেছে বা আগামীতেও উঠে আসবে যা এক বহমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি গল্পের নেপথ্য নায়ক ‘সময়’ এবং সহনায়ক ‘পরিবেশ’। একটা বিশেষ সময়কালের বিশেষ পরিবেশের জীবনের চাওয়া পাওয়া হাসি কান্নাই গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। শ্যমলেন্দু চক্রবর্তী থেকে হাল আমলের কনকদীপ শর্মার অর্ধশতকের প্রজন্মের ব্যবধানে বরাক উপত্যকার সাধারণ মানুষের জীবনবোধ এবং জীবন ধারা অনেক বদলে গেলেও শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি যার জন্য একই সূত্রে গ্রন্থিত করতে বেগ পেতে হয় না। লেখকের নাম না দেখেই গল্প পাঠে জল, মাটি ও কাঁদার গন্ধে বরাক উপত্যকার গল্পকে চেনা যায়। গত অর্ধ শতকের সময়কালে প্রগতির বিপ্লব, মূল্যবোধের বিবর্তন, জীবন বোধের পরিবর্তনের পাশাপাশি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে বরাক উপত্যকার (অবিভক্ত কাছাড়ের) সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা। ষাটের দশকের ‘বঙ্গাল খেদা’ সত্তরের দশকের ‘বিদেশী খেদাও’ আর পরবর্তী কালে এন আর সি বা নাগরিকত্ব আইনের মারপ্যাঁচ বাঙালির জীবনে যে বিড়ম্বনা ডেকে এনেছে সময়ের পারাপারে তা কিন্তু একই আছে যার জন্য বরাকের গল্প বিষয়গত এবং আঙ্গিকগত দিক থেকে যত পরিবর্তন আসুক না কেন ভেতরের দীর্ঘশ্বাস কিন্তু একই রয়ে গেছে। আসরাফ আলির ভিটে হারানোর গল্প আর অর্জুন নমঃশূদ্রের নাগরিকত্ব হারানোর গল্প মিলেমিশে একাকার। মাত্রাহীন ভাষিক আগ্রাসন যখন বাংলা ভাষাকে নিশ্চিন্ন করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করছে না তখন বরাক উপত্যকার নবীন গল্পকারদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সুপ্রভা দত্তের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে অনুরূপা বিশ্বাসের স্বপ্নের উত্তরসূরি মহিলারা এগিয়ে এসেছেন বরাক উপত্যকার গল্পের ভাড়ারকে ভরে দিতে। এই তালিকাটি এতই সুদীর্ঘ যে সকলের নাম মনে রেখে নথিবদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব আর বেছে বেছে কয়েকজনের নেওয়া উচিত হবে না মনে করে আলোচনাকে নৈর্ব্যক্তিক রাখাই সাব্যস্ত করলাম। পুঁথি থেকে কাগজের বই, লেটার প্রেস থেকে ডিজিটাল অফসেট প্রিন্টিং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাহিত্য চর্চার প্রচার ও প্রসার এগিয়েছে। সাম্প্রতিক কালের সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করতে গিয়ে অনেকেই গল্প লেখার মূল স্রোতে চলে এসেছেন এবং বরাক উপত্যকার গল্প চর্চা বিষয়ক কোন আলোচনাই তাঁদের নাম না নিয়ে করা সম্ভব নয় যেমন শর্মিলী দেবকানুনগো, সুদীপ্তা ভট্টাচার্য প্রমুখ। সব সাহিত্যেই যেমন সব গল্প কালজয়ী হয় না আবার সব লেখকও অমরত্বের আসনে বসতে পারেন না। কাল স্রোতে অনেক লেখকই ভেসে গেছেন কিন্তু বরাক উপত্যকার সামগ্রিক ধারাবাহিকতায় তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা হওয়া থেকে শুরু করে সুরমা বরাকের মাঝখানে রেডক্লিফ রেখার বিভাজন তারপর ধারাবাহিক ভাষিক আগ্রাসনে যখন বরাক, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী বিধৌত এই সমতল ভূমিতে বসবাসকারী বাঙালিদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার বিরুদ্ধে লাগাতার ষড়যন্ত্রে নাজেহাল বাঙালিরা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় প্রতিরোধের দেওয়াল তুলতে পেরেছে। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের জন্মের সার্থকতা এখানেই। ১৯৮৪ সালে অর্থাৎ জন্মের মাত্র ৭ বছর পর সরকারি কোন অনুদান ছাড়া প্রকাশনার জগতে পা রাখলো বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। লোক সংস্কৃতি গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বরাক উপত্যকার বারমাসী গান’ বইটি বরাক বঙ্গের প্রথম প্রকাশিত বই । তারপর কেটে গেল আরও ৭ বছর। কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ও তাঁর ছাত্র বিশ্বতোষ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ’ শিরোনামে একটি কবিতা সংকলন বরাক বঙ্গ থেকে প্রকাশিত হল। একই বছরে করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য, অনন্ত দেব, তৈমুর রাজা চৌধুরী, নারায়ণ চক্রবর্তী এবং সীতেশ দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ‘বরাকপারের গল্প’ শিরোনামে একটি গল্প সংকলন ও প্রকাশিত হয় বরাক বঙ্গের পক্ষ থেকে। ২০১১ অর্থাৎ ‘বরাকপারের গল্প’ প্রকাশের দুই দশক পর বরাক বঙ্গের পক্ষ থেকে ‘বরাকের গল্প সংগ্রহ’ প্রথম খন্ডের আত্মপ্রকাশ। ‘বরাকপারের গল্প’ এবং গল্প সংগ্রহের মাঝের দুই দশকের প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় কোন সাহিত্য বা সংস্কৃতি বিষয়ক বই নেই, আছে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামের হাতিয়ার একগাদা বই। এটাই বরাক বঙ্গের বিশেষত্ব, এখানেই এই সংগঠনের ব্যতিক্রমী ভূমিকা। অন্যান্য সাহিত্য সংগঠন যেখানে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকে বিনোদন ভেবে অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে রাখে বরাক বঙ্গ সেখানেই বিবেকের ডাকে ঝাপিয়ে পড়ে। না ছিল সরকারি অনুদান, না ছিল কর্পোরেট শক্তির সমর্থন শুধুমাত্র বুকের পাঁজরের আত্মমর্যাদার শক্তিতে এতগুলো বই প্রকাশ করতে হল শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে।
দুই দশকের যাত্রাপথে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও গল্প সংগ্রহ প্রকাশের যে প্রয়াস হাতে নেওয়া হয়নি সেটা কিন্তু ঠিক কথা নয়। প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল কিন্তু নানাবিধ কারণে সফল হয়নি। ‘বরাকের গল্পসংগ্রহ’ প্রথম খন্ডের সম্পাদকীয়তে পাই ‘একটি গল্প সংকলন খুব জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশের মুখ দেখল। অনেক আগে সে প্রয়াস আরেকবার হাতে নেওয়া হয়েছিল। প্রক্রিয়া কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর নানা কারণে তা ভেস্তে যায়। এবার কেন্দ্রীয় কমিটির সদিচ্ছায় এবং সাধারণ সম্পাদকের বিশেষ আগ্রহে সে কাজটি করা সম্ভব হল।' ২০১১ সালে নীতিশ ভট্টাচার্য কেন্দ্রীয় সমিতির সভাপতি, তরুণ দাস সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আর মাশুক আহমদ ছিলেন কেন্দ্রীয় সমিতির সাহিত্য সম্পাদক। প্রথম গল্প সংকলনে আমরা পাই মোট ২৫ জন লেখকের একটি করে ২৫টি গল্প। প্রথম খন্ডের ২৫ জনের নামের তালিকায় দেখি সেইসব উজ্জ্বল নাম যারা বরাকের গল্পবিশ্বকে নির্মাণ করেছেন, বিনির্মাণ করেছেন এবং অবশ্যই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। নবীনে প্রবীণে মেশানো এই তালিকায় ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার অদ্ভুত মেলবন্ধন দেখা যায়। প্রায় সব লেখকই স্বনামখ্যাত, বরাকের গল্পবিশ্ব নির্মাণে তাঁদের অবদান এতটাই উজ্জ্বল যে প্রত্যেকেই এক একটি বাতিস্তম্ভ যাদের আলোয় এই বিশ্ব আলোময় হয়ে আছে এবং থাকবে অনন্তকাল।
উত্তর বিশ্বায়ন সময়কালে কোন সীমিত ভৌগলিক খণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ভাবে আলোচনা করা উচিত নয় কেননা ভিটে হারানোর গল্পই হোক বা নাগরিকত্ব হারানোর গল্পই হোক ব্যতিক্রমী একক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্যালেস্টাইনের লোকেদের জীবন কথা অথবা সিরিয়ার শরনার্থীদের কথা যদি আলোচনা করি কিংবা শ্রীলঙ্কায় তামিলদের অবস্থা বা মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের সংগ্রাম তবে বরাক উপত্যকার সঙ্গে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। বরাকের গল্পবিশ্ব নির্মাণে এই কাজটি নীরবে করেছেন গল্পকাররা। গল্প যেহেতু সাহিত্যের বিষয় তার মধ্যে মানবিক উত্তরণ থাকতেই হবে অন্যথায় সাহিত্যের প্রথম শর্তটিকেই অস্বীকার করা হবে। বরাক উপত্যকার গল্পকারদের গল্পে সেই উত্তরণের কথাই বলা হয়েছে। কোন লেখককেই তাঁর নিজের লেখা একটি গল্পে যেমন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না আবার একটি বা দুইটি সংকলিত বইয়ে সব লেখককে জায়গা দেওয়া যাবে না। এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেই রয়েছে সূচনা থেকে অন্তহীন অভিমুখের উদ্দেশ্যে যাত্রার পথ নির্দেশ। আর এই পথে ২০১৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘বরাকের গল্পসংগ্রহ’ সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ড। এই সংকলনটির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন গৌতম প্রসাদ দত্ত। আরও ১৮ জন গল্পকারের ১৮টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত এই সংকলনে বরাক উপত্যকার তিন জেলার লেখক মনোনয়নের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকাশিত দুই খণ্ডে ৪৩ জন লেখকের ৪৩টি গল্পের মধ্যে প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র আছে বটে তবে সামগ্রিক নয় আংশিক। কেননা শতবর্ষের ঐতিহ্য নিয়ে বরাকের গল্পবিশ্ব এখন এতটাই স্ফীত যে ৪৩ জনের মধ্যে সামগ্রিকতার সন্ধান অর্থহীন তবে এই দুই খণ্ডের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আগামীতে আরও অনেক খণ্ড প্রকাশিত হয়ে সামগ্রিকতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করবে, এই আশা রাখা যেতেই পারে। একমাত্র বরাকবঙ্গের প্রকাশনাতেই ভারসাম্য রক্ষা করা হয় অন্য সব সংকলনে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি থাকে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে ১৯১৫ থেকেই এই উপত্যকায় নিয়মিত গল্প চর্চার ধারাবাহিকতা আছে। প্রাক স্বাধীনতা আমলে একক উদ্যোগে গল্প লেখা ও প্রকাশের পাশাপাশি অনেক যৌথ উদ্যোগের প্রশংসা করতে হয়। প্রয়াত নগেন্দ্র চন্দ্র শ্যাম বা জ্যোৎস্না চন্দের কথা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রাক স্বাধীনতা যুগে তাঁদের সম্পাদিত ‘ভবিষৎ’ এবং ‘বিজয়িনী’ পত্রিকা অনেক গল্পকারের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত ‘নবভারতী’ ‘কিশোর’ ‘উজ্জীবন’ ‘কাকলি’ ‘আলো’ ‘প্রভাত’ ‘স্বাক্ষর’ ‘ফলক’ সহ ‘আমাদের সমকাল’ ‘প্রতিস্রোত’ ‘অঙ্গীকার’ ‘শপথ’ ‘সপ্তর্ষি’ ‘বেলাভূমি’ ‘উধারবন্দ’ ‘কলিযুগ’ ‘খেলাঘর’ ‘সময়’ ‘বিদিশা’ ‘বর্ণিকথা’ নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করছি। ১৯৬৯ সালে প্রয়াত শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘অনীশ’ এবং ১৯৭৩ সালে মিথিলেশ ভট্টাচার্য ও তপোধীর ভট্টাচার্যের যৌথ সম্পাদনায় ‘শতক্রতু’র আত্মপ্রকাশ অবশ্যই দুইটি উজ্জ্বল মাইল ফলক কেননা এই দুই পত্রিকায় শুধু গল্পই থাকতো অন্য কিছু নয়। যদিও কালীকুসুম চৌধুরী সম্পাদিত ‘লুব্ধক’ এবং অমিত কুমার নাগ ও অতীন্দ্রমোহন গুপ্ত সম্পাদিত ‘সম্ভার’ পত্রিকা বেশ কিছু ভালো গল্প উপহার দিয়েছে। ১৯৯৪ সালে করিমগঞ্জ থেকে ‘বরাক উপত্যকার নির্বাচিত গল্প’ সংকলনটি সম্পাদনা করেন কশিপ কান্তি দে। অনন্ত দেব, মৃণাল কান্তি দত্ত বিশ্বাস, ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, তৈমুর রাজা চৌধুরী ও মিলন উদ্দিন লস্করের যৌথ সম্পাদনায় ১৯৯৭ সালে ‘গল্প পঞ্চদশী’ আত্মপ্রকাশ করে। মহুয়া চৌধুরী (তৃতীয় ভুবনের গল্প), ভবানী চক্রবর্তী (ঈশান বাংলার গল্পগুচ্ছ ও অর্ধেক আকাশ), সুমিত্রা দত্ত (সাধারন মেয়ের গল্প), জ্যোৎস্না হোসেন চৌধুরী (ছুটির দুপুর) একক সম্পাদনায় গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে ‘মানবী’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে , বছরে চারটি সংখ্যার সম্পাদনা পালা করে দোলনচাঁপা দাস পাল, চন্দ্রিমা দত্ত, শেলী দাস চৌধুরী ও শর্মিলা দত্ত করে থাকেন। ‘মানবী’ পত্রিকায় পুরুষদের লেখা গল্পও থাকে। দোলন চাঁপা দাস পাল, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, সুপ্রদীপ দত্ত রায়ের যৌথ সম্পাদনায় অণু গল্পের সংকলন ‘বৃষ্টিকথা বরাকের ছোটগল্প সংকলন’ ২০২৩ এর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়। আন্তর্জালিক পরিসরে লেখা অণুগল্পের এই সংকলনে সর্বমোট ৫৬টি গল্পের মধ্যে যেমন প্রবীন গল্পলেখক মিথিলেশ ভট্টাচার্য, মহুয়া চৌধুরী প্রমুখ আছেন আবার নবীন প্রজন্মের তৃণময় সেন, পাপিয়া সিকিদারও আছেন।
ষাটের দশকে শিলচর থেকে প্রকাশিত দৈনিক খবরের কাগজ ‘প্রান্তজ্যোতি’কে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন কবিরা সংঘবদ্ধ হয়ে যৌথ কবিতা লেখার চর্চার সূচনা করেছিলেন যার পথ ধরেই আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘অতন্দ্র’ যুগ। অনুরূপ গল্পকাররাও প্রান্তজ্যোতি পত্রিকার আশ্রয়ে জমায়েত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে আত্মপ্রকাশ করা ‘শতক্রতু’ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। প্রায় অর্ধশতক অতিক্রম করে অত্যন্ত বৃহৎ কলেবরে ২০১৭ সালে প্রায় ৩৪ জন লেখকের একাধিক গল্পের সম্ভার নিয়ে ‘শতক্রতু’র প্রকাশ একটি ঐহিহাসিক দলিল হিসেবে মান্যতা দাবি করতে পারে। ‘শতক্রতু’র এই সংকলনে মিথিলেশ ভট্টাচার্য, শেখর দাশ, অরিজিৎ চৌধুরী, তপোধীর ভট্টাচার্য সহ অনেক লেখককে সামগ্রিক না হোক আংশিক মূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে। কোন একটি একক সংকলনে একজন লেখকের একাধিক গল্প সাধারণত থাকে না আর একজন লেখককে তাঁর লেখা একটি গল্পে মূল্যায়নে বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকে না, শতক্রতুর এই সংখ্যাটি একটি ব্যতিক্রমী এবং অত্যন্ত মূল্যবান সংকলন।
যদিও বরাক উপত্যকা থেকে ‘যাপনকথা’ প্রকাশ হয় না কিন্তু ‘যাপনকথা’ গল্প পত্রিকায় বরাক উপত্যকার গল্পলেখকদের একাংশের প্রতিনিধিত্ব থাকে। দেশভাগের উপর লেখা গল্প নিয়ে ‘যাপনকথা’ সংকলনটি আরও একটি ঐতিহাসিক দলিল। দেশভাগের মত অভিশপ্ত ঘটনা যা বাঙালির জাতীয়তাবোধকে ছিন্নভিন্ন করে আর্থ সামাজিক বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের উন্নাসিকতা এক বাস্তব সত্য। ‘যাপনকথা’র দেশ ভাগের উপর লেখা গল্প নিয়ে প্রকাশিত সংকলনে বরাক উপত্যকার অনেকের লেখা আছে। দেশভাগ যে একটি বহমান প্রক্রিয়া বরাক উপত্যকার মানুষ ছাড়া আর কে বুঝবে! একের পর এক প্রত্যাহ্বান বাঙালি আর্থ সামাজিক বিপন্নতাকে বিপন্নতর করেছে, আত্মসম্মানে আঘাত দিয়ে বারবার অপমান করেছে তার বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকার বাঙালি হয়তো প্রতিবাদী হয়ে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি কিন্তু সাম্প্রতিক কালে লেখা হৃদয়ের রক্তক্ষরণের লাল কালিতে লেখা গল্পে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বেদনাকে তুলে ধরতে পেরেছে।
অতন্দ্র যুগের অন্যতম শ্রেষ্ট কবি বিজিতকুমার ভট্টাচার্য কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবেই পরিচিত। বিজিতবাবুর সম্পাদনায় মাসিক ‘সাহিত্য’ পত্রিকা ও ‘নির্বাচিত সাহিত্য’ গল্প ও উপন্যাস বিষয়ক খণ্ডে শুধু গল্প প্রকাশেই নয় তার অতিরিক্ত বরাক উপত্যকার গল্পগুলোকে নিয়ে জমজমাট আলোচনায় অনেকগুলো গল্পকে এক সূত্রে বেঁধে দিয়ে তার অনন্যতার দিকটিকে তুলে ধরেছেন। আশিসরঞ্জন নাথের সম্পাদনায় গবেষণাধর্মী লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রবাহ’ এই উপত্যকার মানচিত্রকে অতিক্রম করে বৃহত্তর পরিসরে এখন সমাদৃত। কোবিড সমগ্র বিশ্বকে অচল করে দিতে পেরেছিল কিন্তু বরাক উপত্যকার গল্পবিশ্বকে অচল করতে পারেনি। ২০২১ এর ডিসেম্বর মাসে উত্তর-পূর্বের বাংলা গল্পের ডালা নিয়ে ‘প্রবাহ’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশে আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতার প্রকাশ দেখা গেল। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, অমিতাভ দেব চৌধুরী, সঞ্জীব দেব লস্কর, আশিস রঞ্জন নাথ, তৃণময় সেন, আদিমা মজুমদার, কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য, মনমোহন মিশ্র প্রমুখ বরাক উপত্যকার লেখকরাই এই সংকলনে অগ্রাধিকার পেয়েছেন।
হাতে এসেছে ‘ঈশান’ শারদ সংখ্যা। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, রণবীর পুরকায়স্থ, অমিতাভ সেনগুপ্ত, শর্মিলা দত্ত, শর্মিলী দেব কানুনগো, কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য, রূপরাজ ভট্টাচার্য সহ অনেক গল্পকারের গল্প আছে ‘ঈশান’ শারদ সংখ্যায়। বরাক উপত্যকার গল্পভাবনা নিয়ে মত প্রকাশ করেছেন স্বপ্না ভট্টাচার্য, মিথিলেশ ভট্টাচার্য এবং তপোধীর ভট্টাচার্য। অমিতাভ সেনগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ঈশান’ সাহিত্য পত্রিকার এই সংখ্যাটি যথেষ্ট পরিণত ভাবনা চিন্তা ও সম্পাদনার স্বাক্ষর রেখেছে।
এডগার অ্যালেন পো বলেছিলেন ‘ছোটগল্প হচ্ছে গদ্যের সর্বোত্তম রূপ, এতে সবচেয়ে বেশি সুযোগ থাকে গদ্যের ওপর দখল দেখানোর’। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা গল্পে এসেছে অনেক পরিবর্তন। শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’ ‘রামের সুমতি’ বড় গল্প হিসেবে বের হল। রবীন্দ্রনাথ ছোট গল্পের আঙ্গিকে যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছিলেন কিন্তু মেদহীন করতে পারেননি। তুলনামূলকভাবে সুবোধ ঘোষ, সন্তোষ ঘোষ, বিমল মিত্র সহ অনেকেই গল্পকে মেদহীন করে আকারে ও প্রকারে ছোট করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ বা সমরেশ বসুর ‘আদাব’ তো কালজয়ী গল্প। চেকভ, মপাসা প্রমুখ থেকে অনুপ্রাণিত বাংলা ছোট গল্প তার স্বকীয়তা অর্জনে আন্তরিকতার ত্রুটি রাখেনি। বরাক উপত্যকার গল্প ভূবন ও ব্রাত্য নির্বাসিত একলব্যের মত একাগ্র সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে বাংলা সাহিত্যকে ফুলে ফলে পল্লবিত করেছে। ঠিক যেভাবে পাঁচ দিনের ক্রিকেট ম্যাচের জনপ্রিয়তা কমে পঞ্চাশ ওভারের একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হল এখন সবার আই পি এল বা টি২০ ম্যাচের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। গল্পের ক্ষেত্রেও অণু গল্পের যুগ শুরু হয়েছে কালক্রমে পরমাণু গল্পের দিকে পা বাড়াচ্ছে। সব গল্প যে গল্প হয়ে ওঠে না আবার কিছু গল্প ভালো গল্প হয়। গল্প মানে প্রতিবেদন নয়, যখন প্রতিবেদনের স্তর অতিক্রম করে প্রতিকী হয় তখনই সেটার সাহিত্য মূল্য ধার্য হয়। বরাক উপত্যকার অনেক গল্পই সার্থক অণুগল্প হয়ে সংকলিত হয়েছে।
বরাক উপত্যকা থেকে প্রকাশিত এতগুলো দৈনিক খবরের কাগজের রবিবারের সাহিত্য আসরে একটি করে গল্প ছাপা হলেও মাসে কতটি হয় আর বছরে কতটি হিসেব করে দেখা যায়। রবিবারের পত্রিকায় সাধারণত নবীনদের গল্পই যায় তবুও মাঝেমধ্যে শান্তশ্রী সোম, মঞ্জরী হীরামণি রায়, রূপরাজ ভট্টাচার্য সহ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত গল্পকারের গল্প পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের ঘাত, প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব নিয়ে নয় প্রান্তিক মানুষের জীবনের সংগ্রাম, প্রত্যাশা ও সমাজ বাস্তবতা নিয়ে শৈলেন দাসের লেখা গল্প অতি প্রশংসিত এবং সুপ্রসিদ্ধ গল্পকার রণবীর পুরকায়স্থের স্নেহধন্য। বরাক উপত্যকার অনেক লেখকের গল্প নিয়মিত ‘প্রতিলিপি’ অ্যাপে পাওয়া যায় তার বাইরে আছে বিভিন্ন গ্রুপ যেখানে নিয়মিত গল্প দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। শ্রীভূমির ছেলে শংকু চক্রবর্তী কর্মসূত্রে শিলং থাকেন, সেখানে থেকেও তিনি নিয়মিত গল্প লিখে যাচ্ছেন। বরাক উপত্যকার গল্পকার দেবব্রত চৌধুরীর অকাল মৃত্যু বা শেখর দাশের অসুস্থতা বা জীবন সঙ্গিনীর অপরিণত মৃত্যুতে রণবীর পুরকায়স্থ বা মিথিলেশ ভট্টাচার্যের ব্যক্তি জীবনের বিপর্যয়জনিত ঘটনায় বরাক উপত্যকার গল্পবিশ্বের অনেক ক্ষতি হয়েছে। রণবীরদার গল্পের রসের স্বাদটাই আলাদা, যেমন ‘রঞ্জন আসছে’ গল্পে পাই ‘ব্যাটা সিলেটি জন্ম থেকে কলকাতায় পঞ্চান্ন বলতে পারেনা—মিনি হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে’। রণবীরদার সব গল্পেই পাই সেই অদৃশ্য সেতু যা বরাক উপত্যকার সঙ্গে কলকাতার যোগ ঘটায়। ব্যক্তি জীবনের বিপর্যয়কে কাটিয়ে তিনি আবার আগের মত লিখবেন এটাই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা। শেখর দাশের গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকে কাব্যময়তা আরও স্পষ্ট করে বললে পরাবাস্তবতাবাদ। যেমন পাই ‘ভিক্ষুক’ গল্পে ‘খস-খস শব্দের ভেতরে শুকনো পাতার বুকে রাতের যাযাবর প্রজাপতিরা উড়ে এসে বসল। অগুন্তি প্রজাপতির দেহ ভেদ করে লক্ষ লক্ষ জোনাকি বেরিয়ে এল। জোনাকিরা পথ দেখিয়ে বিধুকে নিয়ে চলল কোনও এক সুনীল প্রণালীর কিনারায় .....................নীল জলে ভরা দীঘির পাড়ে বসে থাকে বিধু। আকাশের চাঁদনি প্রকৃতি রচনা করে তখন। ছোট একটা নুড়ি ছুঁড়ে দিল নীল জলের দেহে। মূর্ছনার মাধ্যম হয়ে কে যেন বলে ‘কী তোমার নাম’। বড় বেশি তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল, দেবব্রত চৌধুরী (চঞ্চু), শুধু গল্প লেখায় নয় সিনেমা নির্মাণে দক্ষ চঞ্চুর গল্প যেন চিত্র নাট্য। ধরা যাক তাঁর ‘বিপদসীমা’ গল্প। বন্যা নিয়ে অনেক গদ্য আছে, খোদ শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর লেখা আছে তারপরেও কোন তুলনায় না গিয়ে বলছি এই গল্প পুরো শরীরটাকে নাড়িয়ে দেয়।
কোন একজন সমালোচক ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্ন করে বলতেই পারেন বরাক উপত্যকার গল্প তো বাংলা গল্পই তাহলে বরাকের ‘গল্পবিশ্ব’ বলে এত আদিখ্যেতা দেখানোর প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে বলব আছে হাজার লক্ষ উদাহরণ তো এই স্বল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়, দুই একটা দিয়েই বরাক উপত্যকার গল্পবিশ্বের অনন্যতাকে বুঝতে চেষ্টা করব। যেমন মেঘমালা দে মহন্তের লেখা ‘লাইসাম্ফি’ গল্পে পাই ‘জিরির পাড়ে নুয়ে পড়া ঘন গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের বাড়িগুলির ছোটো ছোটো স্থির জোনাকির মত আলো। নদীর ওপারে দূরে আকাশে বিশাল আলোর আভা- লক্ষীপুর আলোর আভা ওটা। আর সমস্ত জিরির বুক আলো করে জ্বলছে বেমথৈর বুঙো তম্বা’ একটা ছোট গল্পের পরিসরে যেমন আছে মাতৃত্বের সংবেদনশীলতা, আছে লোভী পুরুষের দৃষ্টি। অন্যদিকে যেমন আছে গল্পের নায়ক তম্বার বীরত্ব আবার আছে অর্কমণ্য পুরুষদের কথা। মেঘমালার এই গল্প যে বরাক উপত্যকার একান্ত নিজস্ব গল্প তা বলার অপেক্ষা রাখেনা, এই গল্পে বরাক উপত্যকার ভৌগলিক অবস্থানেই শুধু নয় বহুত্ববাদী সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। আবার দেখি কৃষ্ণা মিশ্রভট্টাচার্যের ‘ইত্বরবানু এবং মাসমিডিয়া’ গল্পে
--- ‘অ্যাকচ্যুয়ালি, দে আর বাংলাদেশি ইললিগ্যাল ইমিগ্রান্টস। পুলিশনে সারে ঝোপড়ি, জুজ্ঞি তোড়ফোড় কর দিয়া
-----আর দে রিয়ালি বাংলাদেশিস? ওর
-----হু কেয়ারস’
২০০৫ এ লেখা এই গল্পে যে সমাজ বাস্তবতা উঠে এসেছে তার পথ ধরেই তো এন আর সি আর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিষয়ক হুলুস্তুল কাণ্ড কারখানা ঘটল।
বরাক উপত্যকার গল্প মানেই কি নাগরিকত্ব আর সংগ্রামের সেখানে কি প্রেমের গল্প হয় না? সেখানে কি নিছক প্রেমের গল্প হয় না। কেন হবে না? হয় কিন্তু যে প্রেম বা ব্যক্তি জীবন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সেটা তো আলোচনার বিষয় হয় না । আমরা তো সেই গল্পই আলোচনা করব যে গল্পে ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবন মিলেমিশে একাকার। যেমন গণেশ দে’র লেখা ‘বন্দুকের ট্রিগারে আঙ্গুল’। সেখানে শুনি বাবা ও ছেলের দ্বিরালাপ ও দ্বৈরথ।
----- ‘কোন মুসলমান মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না
------তোমাদের কথায় কী পরস্পর বিরোধীতা বাবা, আমাকে বলছ বিয়ে করতেই হবে। আবার বলছ মুসলমান হলে বিয়ে করতে পারব না –হিন্দু হলে আপত্তি নেই! আশ্চর্য!
----- কীসের আশ্চর্য! হিন্দু আর মুসলমানে বিয়ে সম্ভব নয়।
------কেন নয়। বিয়ে তো সহাবস্থান। অরণ্যে দেখোনি দুটো গাছ পাশাপাশি কেমন সুন্দর একটা অন্যটার ডালপালার ফাঁকে নিজের ডালপালা জড়িয়ে শত বছর বেঁচে থাকে।
----- তবু সম্ভব নয়, তাহলে একটা গোলমাল পাকাবেই।
------- না বাবা। পাকিয়ে না তুললে কোন গোলমালই পাকায় না। আর তোমাদের সমাজের কথা বলছ? বলেই হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়েছিল ছেলেটা।'
হিন্দুত্বের জোয়ারে যখন দেশ ভাসছে তখন যদি আমরা সম্মিলিত পাঠে এই গল্পকে অনুধাবন করতে পারি, এখানেই গল্প পাঠের সার্থকতা কেননা গল্প টাইম এবং স্পেসকে অতিক্রম করে নিয়ে যায় এক উন্নত সমাজ সংসারে যেখানে মানবতাই হয় এক মাত্র ধর্ম। গণেশ দে’র লেখা এই গল্প কি মনে করিয়ে দেয় না সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটিকে। আশির দশকের নেলী গহপুরের গণহত্যা নিয়ে যখন সমগ্র বাংলা এমনকি অসমীয়া সাহিত্য নীরব তখন বরাক উপত্যকার লেখক পার্থপ্রতিম মৈত্র লিখলেন ‘হননেচ্ছা’। গল্পে দেখলাম কীভাবে নেলী গহপুরের গণহত্যা ব্যক্তি জীবনের মানসিক ভারসাম্যকে বিপন্ন করে আত্মহত্যার অন্ধকার পথে নিয়ে যায়।
বৈচিত্রের ডালি নিয়ে বরাক উপত্যকার ‘গল্পবিশ্ব’ এখন অসংখ্য তারকাখচিত এবং নক্ষত্রমণ্ডলীর সমাবেশ। অন্তহীন গন্তব্যে এই বিশ্বের সম্প্রসারণ জ্যোর্তিবিজ্ঞানকে হার মানাবে। অসংখ্য নাম না জানা অপরিচিত লেখকের গল্প পড়ছি, আজ হয়তো সেই সব নবীন লেখকেরা বামুন তারা কোন একদিন জ্বলে উঠবে জ্বলজ্বল করে। জ্যোৎস্না চন্দের ‘বিজয়িনী’দের মিছিলে স্বপ্না ভট্টাচার্য, মহুয়া চৌধুরী, ঝুমুর পান্ডে, সুনন্দা মজুমদারের পরের প্রজন্ম শান্তশ্রী সোম, শর্মিলা দত্ত, শর্মিলী দেব কানুনগো, মঞ্জরী হীরামণি রায়, সুদীপ্তা ভট্টাচার্যরা যোগ দিয়েছেন। গল্প লেখিকা জয়া দেবকে আসাম সরকার সম্মানিত করে বরাক উপত্যকাকে গর্বিত করেছেন। এই লেখার কাজ যখন চলছে তখনই হাতে এল দীপক চক্রবর্তী ও মিথিলেশ ভট্টাচার্যের গল্প বই উন্মোচনের আমন্ত্রণ। হয়তো এই লেখা প্রেসে গিয়ে ছাপা হতে হতে আরও অনেক লেখা প্রকাশ হবে। এক কথায় বরাকের ‘গল্পবিশ্ব’ সম্প্রসারণশীল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন