![]() |
রমা পুরকায়স্থ |
। রমা পুরকায়স্থ ।
বিগত ৫ অক্টোবর ২০২৪ ইংরেজি তারিখে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষা এবং অসমীয়া ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। তামিল, সংস্কৃত, তেলেগু, কানাড়া, মালয়ালম, ওড়িয়া ভাষার সঙ্গে মারাঠি, খালি, প্রাকৃত, বাংলা এবং অসমীয়া নবতর সংযোজন। সরকারী নির্দেশে রাজ্যগুলিতে সগৌরবে, সাড়ম্বরে ভাষা গৌরব সপ্তাহ পালিত হচ্ছে রাজ্য জুড়ে।
ধ্রুপদী সাহিত্য বলতে আমরা বুঝি যা eternal বা চিরন্তন সাহিত্য। সুপ্রাচীন কাল থেকে বহমান। বাংলাভাষার জন্মলগ্ন খ্রিষ্টীয় দশম দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ধরে নেওয়া হয়। যার আদিতম নিদর্শন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' বা 'চর্যাপদ' কিংবা 'হাজারো বছরের পুরানো বাংলাভাষায় রচিত বৌদ্ধগান ও দোঁহা। ভাষাতাত্ত্বিক ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রভৃতি বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা মনে করেন এই গ্রন্থের রচনাকাল দশম-দ্বাদশ শতাব্দী। তাই যদি হয়ে থাকে বাংলাভাষা ধ্রুপদীভাষার স্বীকৃতি পাবার যোগ্যতা অনেক আগেই অর্জন করেছিল। মধ্যভারতীয় আর্যভাষা সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃতের বিবর্তনের ধারায় বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া ভাষাগুলো সমগোত্রীয়। সে যাই হোক বিলম্বে হলেও এ গৌরব বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় সকলের। সরকার প্রদত্ত এই সম্মান লাভ না করলেও বাংলাভাষা-সাহিত্য যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান রয়েছে- একথা অনস্বীকার্য।
সমৃদ্ধশালী বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য অব্যাহত গতিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দাদি আত্মীকরণের মাধ্যমে নিজেকে করে তুলেছে সুসমৃদ্ধ। যে ভাষার গ্রহণযোগ্যতা যত বেশি ততই সে নিজেকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম। ভাবের ক্ষেত্রেও তদ্রূপ। বৈচিত্র্যময়তা রয়েছে বাংলাসাহিত্যের আঙ্গিনায়।
বাংলা ভাষাকে অমসৃণ গতিপথে পথ চলতে হয় অহরহ। তাই বলে থেমে থাকাটা ভাষার ধর্ম নয়। বাঙালী জাতির অস্তিত্ব তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর দণ্ডায়মান। প্রতিটি বাঙালীর দায়িত্ব মাতৃভাষাকে সুরক্ষিত রাখা। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে বাঙালির অস্তিত্ব বিলীন হতে খুব একটা সময় লাগবে না। সংস্কৃতির অবক্ষয় রোধ করাটা প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাভাষা আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। বিশ্বের সবচেয়ে সুমিষ্ট ভাষার স্বীকৃতিধন্য।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় নিজ ঘরে আমরা সমস্যাদীর্ন! বরাক উপত্যকার কথাই ধরা যাক - বাংলাভাষার পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়া, স্কুল বলছে- বাংলাভাষা শিক্ষকের অভাবে পাঠদানে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোথাও বা বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে। উপরন্তু বাঙালী অভিভাবকেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন, সেখানে কম বেশী বাংলা শেখানো হলেও অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। তাতে করে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য থেকে রস গ্রহণে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। 'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম' - শিশুকে প্রথমে মাতৃভাষায় পাঠদান অত্যন্ত জরুরী। উচ্চশিক্ষার জগতে না হয় ইংরেজি শেখানো যেতে পারে। মাতৃভাষার সাথে সাথে অন্যান্য ভাষার পাঠ গ্রহণ কোনো নিন্দনীয় ব্যাপার নয়। অন্যান ভাষাকে অবজ্ঞা করে নয় যথার্থ সম্মান দিয়েই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। নয়ত কোনো শিক্ষাই সম্পূর্ণ পারে না। সাহিত্য-সংস্কৃতি আমাদের চেতনার দ্বার উন্মুক্ত করে, মনুষ্যত্ব অর্জনের সহায়ক হয়- সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।
ভারত সংস্কৃতিকে ধারণ করে রেখেছে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবদ গীতা প্রমুখ সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত গ্রন্থসমূহ। ভারতবর্ষকে জানতে গেলে সেগুলো অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরী। এই সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাদান ভারতবর্ষে কেবলমাত্র হাতে গুণা কটি রাজ্যে চালু আছে। আসাম রাজ্যে স্কুল কলেজ থেকে সংস্কৃত ভাষায় পঠন পাঠন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ যে কত বড় অশনি সংকেত!!
আসুন আমরা সবাই মিলে সগৌরবে ভাষাগৌরক সপ্তাহ পালনের সাথে সাথে বাংলাভাষার সুরক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করি। আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালীর। বংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই।
'মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি! বাংলা ভাষা।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন