পঁচিশে বৈশাখ ও রবীন্দ্র প্রভাব


ড. অর্পিতা রানী দাস

সুখ-দুঃখে, আনন্দ-শোকে, প্রেমে-বিমর্ষতায়

তুমি যে বিরাজমান বাঙালির মণিকোঠায়।

তোমার সৃষ্টির ভুবন

নতুন ভাবে বাঁচার রসদ জোগায়।

বিধ্বস্ত মন যেখানে মৃত্যুও অসহনীয়

তোমার কবিতা, গান করে পুনরুজ্জীবিত।

ভাষা হারা দিক ভ্রষ্ট পথচারী 

ঠিকানার খোঁজ পায় তোমার রচনায়।

'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা'

তাই পঁচিশে বৈশাখ তোমার জন্মদিনে 

তোমার গানেই তোমার আরাধনা।

   "বাঙালির গর্বিত সংস্কৃতির ইতিহাসে বেঁচে আছে দুটি-তিনটি বাংলা তারিখ -১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ, ৭ই পৌষ, ২২শে শ্রাবণ। এর মধ্যে তিনটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক মহাপুরুষকে ঘিরে।" রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা হতো, ঘটা করে সাড়ম্বরে এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি, বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন-মানসিকতা বিকাশে রবীন্দ্রনাথের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের প্রতি ঋণ স্বীকার করে।

   ১৮৮৬ সালের ২৫শে বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন "আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ - পঁচিশ বছর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের।" এইটুকু পড়ে আমাদের মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথ নিজের জন্মদিন নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন কিন্তু এই ধারণা ভেঙ্গে যায় যদুনাথ সরকারকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে ।কবি লিখেছিলেন, "এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সংকোচ অনুভব করিতেছে তাহা অন্তর্যামীই জানেন।"

   রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশায় নিজের জন্মদিন উদযাপন নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না তাই ২৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম জন্মদিন উদযাপিত হয়। তারপরও কবির জন্মদিন আরো ২২ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের আড়ালে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি তাঁর বিশ্বজোড়া গুণগ্রাহীদের আকুল আবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের কাছে হার মেনেছেন কবি। কবির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম উদযাপিত হয় ১৮৮৭ সালে কবির তখন ২৬ বছর বয়স।

"হে নূতন

দেখা দিক আর -বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন 

সূর্যের মতন...।"

   জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই নিজের হৃদয়ে নূতনের আহ্বান উপলব্ধি করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অমিত প্রতিভায় বাঙালির রুচি ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। সাহিত্যের নানা শাখা থেকে সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও নাটক পর্যন্ত বিচিত্র শিল্প ক্ষেত্রকে তাঁর প্রতিভার স্পর্শে অনন্য করে তুলেছিলেন। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্য প্রতিষ্ঠা করেন। 

      

     বিশ্ব বরেণ্য রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন সাহিত্যের সমগ্র শাখায়। রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠ করলে বোঝা যায় এ হচ্ছে যেন পড়ন্ত বেলার রামধনু। রং ও রূপের বাহার ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে আছে তাঁর সৃষ্টির ভুবন জুড়ে। তাঁর সৃষ্টির সম্ভার পরিমাণে ও বৈচিত্র্যে বিপুল। যতদিন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যচর্চা থেকে জীবনদর্শন বহু যুগ ধরে বাঙালির জীবনকে প্রভাবিত করে আসছে।তাঁর সাহিত্যের ভুবন সমৃদ্ধ করেছে বাঙালির সংস্কৃতিকে। বাঙালির সংকটে, সংগ্রামে, আনন্দে, বেদনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছে ।ইতিহাসের নানা বাঁকে নতুন ব্যঞ্জনায় তাঁর সৃষ্টি সমকালের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু সৃষ্টিশীল চর্চাতে নিজেকে নিমগ্ন রাখেননি। সমাজ সংস্কার, কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি সহ নানা বিষয় চর্চা তার ভাবনা ও কর্মশীলতার বিস্তৃত সমীহ জাগানোর মতো। তাছাড়াও আলোচ্য বিষয়ের উপর দৃষ্টি রেখে বলা যেতে পারে যে বলা হয়ে থাকে বৈশাখ মাসে যেহেতু রবীন্দ্রনাথের জন্ম তাই কবির রয়েছে বৈশাখ মাসের প্রতি একটু বিশেষ টান। তিনি অনেক কবিতা ও গানে বৈশাখ মাসকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। যদিও ১৯৩৬ সাল থেকে বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন প্রবর্তিত হয় ফলে বর্ষবরণ কিংবা জন্মদিন বরণ একটি ভিন্ন রূপ লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদা সুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। ঠাকুর বাড়ির পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁর চিত্তকে শৈশব থেকে গড়ে তুলেছিল। জমিদারির কাজে পূর্ব বাংলার নদীপথ ,নিসর্গ ও গ্রামীণ জীবনযাত্রা তার মন চিরদিনের জন্য বদলে দেয়।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কেবল প্রেরণাই দেননি নিজেও সোচ্চার হয়েছেন। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডে ব্রিটিশ শাসকদের নিশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বর্জন করেছিলেন তাদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ।তার দীর্ঘ ৮০ বছরের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটেছিল ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ।

    রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশালতা ও গভীরতায় বাঙালি জাতি ঋদ্ধ হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ও রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার উৎস।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে উপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ,ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীত শ্রষ্টা, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। উপন্যাস, কবিতা, সংগীত, ছোটগল্প, নাট্য প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী সহ সাহিত্যের সকল শাখা ই ধারণ করে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একাধারে নাট্যকার ও নাট্যভিনেতা দুই ছিলেন ,কোন প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া চিত্রাঙ্কন করতেন। তৎকালীন সমাজ সংস্কারে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই।

     মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তার সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। বাঙালি জীবনের প্রতিটি পর্ব, প্রতিটি উপলব্ধি নিয়েই লিখে গিয়েছেন ।বাঙালি তার হৃদয়ের সব আবেগ, অনুভূতির ভাষা খুঁজে পায় রবীন্দ্রনাথের কালোজয়ী রচনায় ।মানুষের এমন কোন মানবিক অনুভূতি নেই যা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির শাখায় পাওয়া যায় না ।সভ্যতার সব সংকটে রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল সমাধান। অন্ধকারে এক বিরাট আলোর প্রদীপ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি সারা জীবনের সাধনায় অসাধারণ রূপে লাবণ্যমণ্ডিত করেছেন। অতুলনীয় ও সর্বতমুখী প্রতিভা দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করে গিয়েছেন।

   রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় শরৎচন্দ্রের সেই চির পরিচিত উক্তিটি - "কবিগুরু তোমার প্রতি চাহিয়ে আমাদের বিস্ময়ের সীমা নেই।"

 ভারতবর্ষের চিন্তনে, মননে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, শিল্পে, নৃত্য গীতে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন পরতে পরতে।একক কোন অভিধায় তাকে চিহ্নিত করা যায় না। বাঙালির উপলব্ধির যেসব ক্ষেত্র রয়েছে তার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাঙ্গালীর অস্তিত্ব কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক মহান প্রাণপুরুষ, যাঁর অস্তিত্ব কখনো মুছে ফেলা যাবে না। যেমনটা যায়নি ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ারকে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যে নক্ষত্র আলো ছড়াতে থাকবে সমগ্র সৃষ্ঠি ব্যাপী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং সদা থাকবেন আমাদের হৃদয় গহীনে। কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখতে গেলে লেখার অন্ত নেই। জীবনের কত দিকে তাঁর বিস্তার, বাঁক এবং বাঁকান্তর।

 শুধু মাথা নত করে বলতে হয় 

"তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা,

.....

কোনখানে রাখবো প্রণাম।"


[প্রতাপ ঃ অনলাইন-৪]

1 টি মন্তব্য:

  1. যতদিন বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্ব বেঁচে থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ ও থাকবেন কালের কণ্ঠ হয়ে। তাত্ত্বিক আলোচনায় সেটাই তুলে ধরেছেন লেখিকা তার বিচার বিশ্লেষণে।

    উত্তরমুছুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১)

প্রচ্ছদ  :  শুভজিৎ   পাল সম্পাদকীয় ......... বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব , দুর্গাপূজা। এই সময়টিতে বাঙালির প্রাণের মিলন , সংস্কৃতি আর ঐতিহ...