[গল্প]
- স্মৃতি দাস
টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার বছর
খানেক পরে গীতশ্রী চন্ডিকাপুর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে এপোয়েন্টমেন্ট পেল। শিলচরের
প্রাণকেন্দ্রে বসবাস করা গীতশ্রী কখনো পাড়া গাঁ বলতে কোথাও যায়নি।
চণ্ডিকাপুর গ্রাম আদতেই একটি অনুন্নত গ্রাম। রাস্তায় কিছু মানুষ চলাফেরা করছে। চেহারা বা পোশাক দেখে সবাইকেই বেশ
গরীব বলে বোধ হচ্ছে।
গ্রামটি নদীর কূলবর্তী হওয়ায় বোঝা
যায় সেখানে হয়ত বা মৎসজীবি মানুষরাই সংখ্যায় বেশি বাস করেন কারণ অনেক বাড়ির উঠোনেই মাছ ধরার জাল,পলো ইত্যাদি নানান উপকরণ দেখা যাচ্ছে। গীতশ্রী দেখলো একটি সাত আট বছরের মেয়ে উঠোনের বসে একটি ছোট
শলা দিয়ে মাটিতেই কি লিখছে। অটো থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করল- 'খুকি, বলতে পারো প্রাইমারি স্কুলটা কোথায়'?
মেয়েটি প্রথমে
অবাক হয়ে দেখে বলল,'আরো আউগাইয়া যাও, তে পাইবায়।'
'তুমি মাটিতে অ আ লিখছো কেন, তোমার স্লেট পেন্সিল নেই'?
মেয়েটি মুখ বেজার
করে বলল,
'আছে,
বাবায় কইছইন দিনো মাটিত লেখিয়া অইভ্যাস করতাম আর রাইত সেলেটো
লেখতাম। নাইলে বার বার কিনিয়া দিতে বাবার কষ্ট অইব'।
গীতশ্রী অবাক
হলো,
এ কেমন ধারা কথা! মুখে
বলল 'তোমার বাবা কি করেন? মা কোথায়'?
'বাবা মাছ মারাত গেছইন, আর মা তো আস্পাতাল, আমার নু ভাই অইত'।
'তুমি বাড়িতে এখন একা'?
'অয় গো, বাবা মাছ মারিয়া আইলে তান লগে মা-রে দেখাত যাইতাম,
এর লাগিয়া আইজ ইস্কুলো গেছিনা'।
'তুমি স্কুলে পড়ো? কোন ক্লাসে'?
'প্রথম শ্রেণিত ভর্তি অইছি ইবার। তুমি কিতা আমরার ইস্কুলর নতুন
দিদিমণি নি'?
গীতশ্রী হেসে
বলল-
বাহ, তোমার তো বেশ বুদ্ধি, কি করে বুঝলে'?
'কাইল নু হেডমাস্টর স্যারে কইলা গো'..
'ও আচ্ছা বুঝলাম, তোমার নামটা তো বললেনা'....
'তুমি কিতা আমার নাম জিগাইছো নি,
কইতাম যে'...
'আমার নাম গার্গী দাস'
'বাহ, খুব সুন্দর নাম তো। ঠিক আছে তুমি থাকো আমি এবার আসি'...
'আইচ্ছা টা টা'।
গীতশ্রী হেড
স্যারের সাথে দেখা করল। উনি বললেন,
'এসে গেছেন? বসুন, বসুন'।
'বেশ দেরি করে ফেললাম আজ। আসলে রাস্তায় একটি মেয়ের সাথে কথা বলে
একটু দেরি হল। এই স্কুলেই পড়ে,
নাম বলল গার্গী'।
'ও আচ্ছা আচ্ছা, অনন্ত দাসের মেয়ে। পড়ায় খুব মন মেয়েটির। কিন্তু বাপটা ক'দিন যে পড়াতে পারবে সেটাই প্রশ্ন'।
'কেন পড়াতে পারবেনা? একটিই তো মেয়ে।‘
'আজ ক'বছর থেকে অনন্তকে যক্ষা রোগে ধরেছে। প্রায় সারাদিন জলে থেকে
মাছ ধরে। যা ধরে তা বিক্রি করে সংসার চলেনা। শরীর বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আর মাছ ধরতে
যায়না,
তখন হাজিরা কাজ করে। বউটি কাঁথা সেলাই করে,
হাতপাখা বানায়, নারকেলের শলা দিয়ে ঝাড়ু বানিয়ে বিক্রি করে। তবু্ও পেট চালাতে
হিমশিম অবস্থা, মেয়েকে পড়াবে
কি করে '?
বাচ্চা মেয়েটির
নিষ্পাপ মুখটি বার বার মনে পড়ছিল গীতশ্রীর। হেডমাস্টার স্যার বললেন--
'মুকুল বাবু ছুটিতে আছেন। উনি এলে ক্লাস ভাগ করে নেবেন'।
বেশ সুন্দর পরিবেশ,
ফুরফুরে নদীর ঠাণ্ডা হাওয়া আর গাছ গাছালি মনটা একেবারে ভরিয়ে
দিল। ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে গীতশ্রী বাড়ির দিকে ফেরত চললো।
পরের দিন গীতশ্রী যথারীতি স্কুলের দিকে রওয়ানা
হল। স্কুলের কাছাকাছি
একটু এগোতেই দেখতে পেল গার্গীদের উঠোনে কিছু মানুষের জটলা। ওকে দেখে হেড স্যার এগিয়ে
এলেন। বললেন--
'কাল শুনে গেলেন গার্গীর ভাই বোন হবে। প্রসবের সময় অনন্তর স্ত্রী
রুগ্ন একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেল।
রক্তাল্পতা ছিল,
বেচারা অনন্ত রক্ত যোগার করে দিতে পারেনি। আজ স্কুল ছুটি দিয়ে
দিচ্ছি বুঝলেন ম্যাডাম। আপনিও বাড়ি চলে যান। আমি কিছুক্ষণ এখানে থাকি।
গার্গী এতক্ষন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে
স্যারের কথা শুনছিল আর গতকালের ঘটনার কথা, মেয়েটির নিষ্পাপ মুখটির কথা শুধু মনে পড়ছিল। হেড স্যারের হাতে
দুটো পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বলল, 'এটা আমার তরফ থেকে দিলাম, একটু সাহায্য '।
খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনদারিদ্র্য দুর্দশা মানুষকে শেষ করে দেয়।ভীষণ ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন