[অণুগল্প] -শান্তশ্রী সোম
স্বপ্নে অনেকেই ধরা দেয়। সে ক্যুইন ভিক্টোরিয়া থেকে শুরু করে মায় পাশের পাড়ার পাগলা বিশু অব্দি। গত বছর বরম বাবার মেলার সময় টুক করে একপাক ঘুরে গেছে স্বপ্না। বাড়িতে তখন তার সে কী খাতির। গ্রামের রীতা, পায়েল, পূজা, সুনীতা সবাই দলবেঁধে ওকে দেখতে এসেছে। কেউ বলছে, রংটা অনেকটা খুলেছে। কেউ ওর গায়ের জেল্লা দেখে চোখ জুড়োচ্ছে।
স্বপ্নার স্বপ্ন ছিল,
'টাউনে যাব। ভালো ভালো কাপড়চোপড় পরবো। টাউনের মানুসগুলাইনের পারা সাফ গতর হবে। লুকে বইলবেক, সোপ্না, তুকে চিনতে লাই পাইরলম।'
এই টুকরো
'সোপন টু লিয়ে'
শহরে এসেছে স্বপ্না তার মাসির হাত ধরে। বয়স বছর চৌদ্দ। দারিদ্রের জীর্ণতা তার কৈশোরের জৌলুসকে খুব একটা মাড়িয়ে যেতে পারেনি।
বাবুর ঘরে যেদিন প্রথম এলো,
চারদিক পানে তাকিয়ে চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম। তবে রাত আটটা বাজতে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল তার সেই ছানাবড়া চোখে।
এ
বাড়ির সবাইকেই বেশ লেগেছে স্বপ্নার। সবাই কেমন হেসে কথা বলে।
ঘরে খাবার চুরির অপরাধে বিস্তর মার খেয়েছে স্বপ্না। কিন্তু এ বড় বিচিত্তির জায়গা। এখানে খাবার ভর্তি থাকে ঠাণ্ডা আলমারিতে। এছাড়া যত্রতত্র বয়াম, কৌটোতে খাবার ঢুকিয়ে সুন্দর করে সাজানো থাকে। কে--উ হাত অব্দি লাগায় না। বাড়ির দিদিটিকে হাতে তুলে খাবার দিলেও খেতে চায় না। যেন ওসবে ওর কোনো চাহিদাই নেই। প্রথম এক-দু'দিন স্বপ্নার মনে হয়েছিল, ওসব খাবার দেখার জন্যই রেখে দেয় বাবুরা। "হামদের ঘরে খাবার তো মাই নাই দেয়। যা বাপু লিয়ে করে আসে, সব, স--ব টুকুন টুকুন করে ঘরে যিজন থাইকলো, সি হি পায়লো। বাকি যি যি জন ঘরে থাইকবে সি জনেরই মিলবে।" নচেৎ নয়। অর্থাৎ সোজা বাংলায়- ফার্স্ট কাম, ফার্স্ট সার্ভ।
দুদিনে স্বপ্না দেখলো ও
মিষ্টি খেতে ভালোবাসে জেনে বাবুনী ওকে সকাল বিকেল মিলিয়ে দিনে দু-তিনটে মিষ্টি সাপ্লাই করেই চলেছেন। রাতে সোফার নরম গদিতে শুয়ে স্বপ্না ভাবে, "ইটা কুন দেস আছে, যিখানে বাড়ির লুকগুলান খানা খালি সাজাই করকে রাখে। লেকিন খায় না!"
দু হপ্তাও হয়নি। তবে এই ক'দিনে ঘরের কাজকম্মে বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে স্বপ্না। অবশ্য তেমন কিছু শিখতে হয়নি। শুধু ঢং টা বুঝে নিতে হয়েছে, এই যা।
যখন বাড়িতে ছিল,
ওদের বাগান ফাঁড়ির লাইনের ঘরে জল আনতে হত সেই 'চওধরী'-দের 'তালাব' থেকে। লেবার
গেলেও কলের মুখে আর জলের ফোঁটা বৃষ্টি হয় না। এ যেন চাতক চাওয়া। কাজেই ঘরে যেখানে 'কল' দেখছে একবার করে কানটা ঠিকসে মুলে দিয়ে অকারণ এক গঙ্গা জল বইয়ে দিয়ে তবেই সোয়াস্তি পেয়েছে স্বপ্না। কিসের একটা অ-বলা অস্বস্তি তাকে দিয়ে যেন একাজ করিয়ে নিয়েছে। একেই বোধহয় সোজা কথায় রেভেঞ্জ মোটিভ বলে।
সেই স্বপ্নার পাশের ফ্ল্যাটের রিমি আণ্টি, দত্ত দিদা সহ গোটা বাড়িটার প্রায় সবার সঙ্গে ভাব জমাতে লেগেছিল মাত্র দশ-পনেরো দিন। এখন সময় পেলেই সবার ঘরে তার বিস্তর খাতির। এর কারণ তো একটা আছেই। তার সহজ সাবলীল ব্যবহার। সে জানে না 'বদমাশি' কি বিষয়। সে বুঝতে পারে না কেউ বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বললে কেন তাকে 'না' বলতে হয় ! ছাদে কেয়ারটেকার ছেলেটা থাকলে কেন ছাদে যেতে নেই !
এই প্রতিরোধগুলি তাকে বড় কষ্ট দেয়।
'বদমাশি'র মানে জিজ্ঞেস করতে সহজ সাবলীল গলায় কিশোরী লাউডগা মেয়েটা যখন বলে-'গালি দিবে নি হামারে?' তখন বেবাক অবাক হয়ে যান গৃহকর্ত্রীটি। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় তার। এ মেয়েকে আগলে রাখা যে বিশাল ঝক্কির ব্যাপার, তা এই কদিনে ভালোই বুঝে গেছেন তিনি।
সবকিছুর ক্লাইম্যাক্স সেদিন হয়, যেদিন সরস্বতী পূজোর বিকেলে বাবুনীর সঙ্গে পূজো দেখে ফেরার পর পাশের ঘরে আণ্টির কাছে গিয়ে টানা একঘণ্টা বকবক করে মেয়ে। তার শাড়ি পরার গল্প, রাস্তায় ছোট ছোট মেয়েদের শাড়ি পরে হোঁচট খাওয়া দেখে তার অনর্গল হাসির গল্প, সব বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে বলে গেল মেয়ে। পরে রাত আটটা নাগাদ যখন ঘরে এলো ডাকাডাকি শুনে, তখন সবসময়ের হাসিমুখটি শুকিয়ে আমসি। বিস্তর সাধাসাধির পর ঐ গোমড়া মুখের রহস্য উদ্ধার হলে বাবুনীর তো চক্ষু চালের চূড়োয় চড়ার জোগাড়। ছোট্ট অবুঝ স্বাভাবিক ভাবনায় বেড়ে ওঠা না-শিক্ষিত মেয়েটিকে তথাকথিত হাই স্ট্যাটাসের আণ্টি বসিয়ে তার গপ্পো-গাছা শুনে পরে মোবাইলে নিজের অনেকগুলো ছবি তুলিয়েছেন। বিভিন্ন রকমের দামী পোশাকে। সবশেষে যে ছবিটা সে তুলেছে, তাতে ভীষণ মন খারাপ স্বপ্নার। 'মুর শরীলটা আণ্টির পারা সাফ কেনে লাই?' নিঃসন্তান হাইপ্রোফাইল অফিসার গিন্নিটি নানান ঢং-এ নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত থাকেন হরবখত। আজ যে তেনার শখ হয়েছে স্যুইমিং কস্ট্যুমে তার ছবি কতোটা সুন্দর দেখায় , তা-ই দেখার-----!
গল্প নয়, বাস্তবের মাটি থেকে উঠে আসা এক জীবনকথা। লেখকের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং গল্প বলার মুন্সিয়ানায় আবারও মুগ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ। জীবনের কথাই বলতে চাই। বুঝতে চেষ্টা করি। কতটুকু পারি, জানি না। পাঠকের ভালো লাগলেই মন ভালো হয়ে যায়।
উত্তরমুছুন