একটি মেহগনি কাঠের চেয়ার ও একটি অভিশাপ

মঞ্জরী হীরামণি রায়

। মঞ্জরী হীরামণি রায় ।

[প্রতাপ : অনলাইন-১৪]

  মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরিতে আকাশের দারুণ সাজ। জোছনায় ছেয়ে আছে চরাচর। অথচ মনটা ভালো নেই নীহারিকার। দুশ্চিন্তাগ্রস্তও। 

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছিল এমনি এক পূর্ণিমা রাতের কথা। শশাঙ্ক শেখর রায় চৌধুরীর মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসে দেওয়া সেই কঠিণ সিদ্ধান্তের কথা। 

পিঠে আলতো ছোঁয়া পেয়ে চমকে ওঠলেন নীহারিকা। ছোট জা রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এসেছে।

-- কি এত ভাবছ দিদি ? নাকি জোছনা বিলাস! 

-- ধুর পাগলি। 

-- তা হলে নিশ্চয়ই কোনো কবিতার লাইন! দিলুম বুঝি আমি সর্বনাশ করে? 

-- না রে, ও সব কিছুই না। তুই তখন এ বাড়িতে আসিস নি। এমনি এক পূর্ণিমা রাতে দাদাশ্বশুর ওই চেয়ারটায় বসে যা একখানা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন...  

-- কী সিদ্ধান্ত দি?

-- সে অনেক কথা। এই চেয়ারই তো সর্বগ্রাসী রে! 

-- মানে!! এই সামান্য চেয়ার... 

--সামান্য নয় রে, সামান্য নয়। এ চেয়ার শুধু দামি কাঠের আসবাব মাত্র নয়! এ চেয়ার আসলে পিতৃতন্ত্রের প্রতীকী। 

.... কী বলছ দিদি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। 

-- সময় বয়ে গেছে অনেকটা তৃণা। তুই এসব বুঝবি না। চল খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার খাটুনি বাড়বে। 

-- বুঝেছি। তুমি আমাকে বলতে চাইছ না। চলো তাহলে।  

-- রাগ করলি? রাগ করিস না বোন। সময় হলে ঠিকই বলব। 

তৃণা এ কথার কোন উত্তর করে না। নীহারিকা কোন ধাতুর তৈরি, এ দু বছরে তৃণা বেশ বুঝতে পেরেছে। একবার যখন স্থির করে নিয়েছেন বলবেন না, তাহলে আর বলবেনই না। তৃণা ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বলে ---

-- খেতে চলো দিভাই। এবার সত্যিই খাবার জুড়িয়ে যাবে। 


    রাত বাড়ে। আকাশে মেঘ হালকা হতে থাকে। হলুদ আভা মাখা চাঁদটি একবার মেঘ ফুড়ে বেরিয়ে আসছিল আর একবার মেঘে ঢাকা পড়ছিলো। রাত পাখিরা ডানা মেলে দিয়েছে। এখন তাদের শিকারের সময়। নীহারিকা ভেন্টিলেটর দিয়ে চাঁদের লড়াইটা দেখছিল। এক টুকরো মেঘ সরতে না সরতেই আরেক টুকরো তাকে গ্রাস করতে যায়। মেয়েদের জীবন যেমন! এক বেড়ি থেকে মুক্তি পেতে না পেতে আরেকটা বেড়ি পায়ে লাগাম পরায়। নাহ্, আজ বোধহয় আর ঘুম আসবে না। কেন যে ঐ চেয়ারখানার কাছে গেছিল! দাদা শ্বশুর শশাঙ্ক শেখরের কী এত দম্ভ ছিল, কে জানে! সেই দম্ভের উত্তরসূরি হলেন শ্বশুর বাবা। চেয়ারখানাতে বসেই সব সিদ্ধান্ত দিতেন। সেটা রান্নার মেনুই হোক আর বাড়ির সদস্যদের প্রতি কোন নির্দেশই হোক। সেই জোছনা মাখা হালকা মেঘলা রাতে নিকৃষ্টতম সিদ্ধান্তটাও তো এই চেয়ারে বসেই নিয়েছিলেন শ্বশুরবাবা। ছোট ননদ মীনু সেটা মেনে নিতে পারেনি। এমনি এক জোছনা ভরা রাতে পালাতে বাধ্য হয়েছিল মনের মানুষটির সাথে। আর বাড়ি ফেরা হল না। বড্ড হাসিখুশি আর সহজ ছিল মীনু। আর ছিল আত্মাভিমানী। 

    এ বাড়িতে মীনুর নাম উচ্চারণ করাও বারণ হয়ে গেলো এরপর। নীহারিকা হাতে গুণে হিসেব করেন। হয়ে গেল তেরো বছর। কেমন আছে মীনু, বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। শাশুড়িমা তো সেই শোকেই পাড়ি দিলেন ওপারে। তাতে অবশ্য শ্বশুর বাবার প্রতাপ একটুও কমেনি। নীহারিকার মনে পড়ে শাশুড়িমায়ের আর্তনাদ। একটিবার মেয়েটির মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। মেহগনি কাঠের চেয়ারের শক্ত বাঁধুনি তাতে একটুও নরম হয় নি। শাশুড়িমায়ের শেষ কথাটি ছিল -- 'নির্বংশ হোক রায় পরিবার। দরকার নেই উত্তরসূরির। এদের রক্তটাই বিষাক্ত।' 

    এর পর টানা তিন দিন চুপ করে ছিলেন। এক সময়ের হাসি খুশি মিশুকে মানুষটি শোকে পাথর হয়েই পাড়ি দিয়েছিলেন ওপারে। নীহারিকা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দিন পুরো হলে মৃতবৎসা হলেন। কাকবন্ধ্যা হয়েই রইলেন। পর পর তিন জা এলো। নাহ্, কারোরই কোল আলো হয়নি। এবার ছোট জা তৃণার পালা। 


  তৃণাকে কী এসব বলা যায়! সময় হলে সবই জানতে পারবে। রাত বেড়েই চলেছে। নীহারিকার আর ঘুম আসবে না। তৃণা অন্তঃসত্ত্বা। শাশুড়ি মায়ের অভিশাপ কী এ মেয়েটাকেও মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করবে? তৃণা যে তার কন্যা সম। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। 

  ভোরেরদিকে বিছানা ছাড়েন নীহারিকা। হাত জোড় করে শাশুড়ি মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ান। আঁচল মেলে দিয়ে বলেন,

-- অভিশাপ ফিরিয়ে নিন মা। তৃণার কোল আলো হোক। ওই চেয়ার আমি সূর্যোদয়ের আগেই ধলেশ্বরীর স্রোতে ভাসিয়ে দেব...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১)

প্রচ্ছদ  :  শুভজিৎ   পাল সম্পাদকীয় ......... বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব , দুর্গাপূজা। এই সময়টিতে বাঙালির প্রাণের মিলন , সংস্কৃতি আর ঐতিহ...