ক্লেদ

রূপরাজ ভট্টাচার্য

 [প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১)]

। রূপরাজ ভট্টাচার্য ।

টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে কান পাতা দায়। সায়ন জড়ানো জিহ্বায় কী যে বলে চলে, সব কথা ঠিক কানে পৌঁছায় না বৃন্দার। অঝোর বৃষ্টিতে চারপাশ জলে জলাকার। আরেকটু বৃষ্টি দিলেই রান্নাঘরে জল ঢুকবে নির্ঘাত। রান্নাঘরটা শোবার ঘরগুলো থেকে একটু নিচুতে। কারণ বাথরুমসহ চারটে ঘর দু-তলার ফাউন্ডেশন দিয়ে নতুন করা হয়েছে। রান্নাঘরের কনস্ট্রাকশন চলছে। বর্ষার জন্য আপাতত সব কাজ বন্ধ। পুরোনো আসাম টাইপ রান্নাঘরেই এখন রান্নাবান্না চলে। কিন্তু বৃষ্টি এলেই ঐ এক ভয় ঘিরে ধরে বৃন্দাকে। সায়নের অতোসব ভাবার অবসর নেই, ভাবার মতো তার অবস্থাও নয় অবশ্য। বৃষ্টির মধুর রাতে মদির সায়ন বৃন্দাকে একটানে বিছানায় ফেলে। তারপর প্রবল আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায়নের আবেগের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয় বৃন্দা। প্রতি রাতে সেই একই রুটিন। এছাড়া ভালোবাসার আর কোনো ভাষা জানা নেই যেন লোকটার। একসময় হাঁসফাঁস লাগে। তবু নিজেকে ছাড়াতে পারে না কিছুতেই। বাসনার ঘূর্ণিতে ক্রমশ তলিয়ে যায়।

        একসময় ঘুমন্ত সায়নের হাত ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে বৃন্দা। বেডরুম বরাবর নেমে গেলেই কিচেন। সন্তর্পনে ছিটকিনি খোলে। তারপর আন্দাজে হাতড়ে স্যুইচ টিপে আলো জ্বালে। হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছে সে। একপশলার বৃষ্টিতেই গোড়ালি ছাড়িয়েছে জল। রান্নাঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে নিচের সেল্ফে রাখা কৌটোকাট্টা গুলো। হঠাৎ নজরে পড়ে, মাত্র ক'দিন আগে গাঁটের পয়সা খরচা করে এক্সপো মেলা থেকে অনেক সাধ করে কেনা কর্পূরের রঙিন পাথর বসানো রুপোলি বাক্সটা জলে ভাসছে! কী করে যে জলে পড়ে গ্যালো এটা! ইস্! এক ঝটকায় সেটা তুলে নিয়ে বাক্সটা খোলে বৃন্দা। নাহ্! ভেতরে বেনোজল ঢোকেনি একদমই! পাত্রটা টেকসই বলেই নোংরা জল স্পর্শ করেনি এতটুকু! বৃন্দা মনে মনে হাসে! তাহলে এভাবেও সবকিছু থেকে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ভেসে থাকা যায়!

মাঝরাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় বৃন্দা। বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগে। বুকের জমানো দীর্ঘশ্বাস তবু বেরোতে চায় না যেন। হঠাৎ কি মনে করে পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নামে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজতে থাকে। বৃন্দা অনুভব করে তার শরীরে বৃষ্টির এই ধারা-জল তাকে যেন ক্লেদ মুক্ত সবুজের হাতছানি দিচ্ছে। আরও অনন্ত সবুজের ভরসায় অঝোর ধারায় ভিজতে থাকে বৃন্দা...! তবুও যেন স্বস্তি মেলে না কিছুতেই। এবার শাড়ির আঁচল বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দেয় অবলীলায়। উঠোনের জমাট কাদায় সিনথেটিক শাড়িটা গড়াগড়ি খায়। বৃন্দার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অতো রাতে কে দেখবে তাকে? আকাশের দিকে মুখ করে দুহাত মেলে ধরে। বৃষ্টির অকৃপণ ধারাপাতে বৃন্দা জল্লুস ভিজে। মনের আর দেহের সকল ক্লেদ ধুয়ে যাবে বৃষ্টির জলে, এই ভরসায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

এগিয়ে চলো পাশে আছে অগণিত কলম

। চান্দ্রেয়ী দেব ।     ঘুম ভাঙতেই জানালার পর্দা সরাতেই চোখে দাগ কাটে পরিষ্কার আকাশে ঝকঝকে নীল রং ছড়ানো। স্নিগ্ধ হাওয়ার পরশে প্রাণ ফিরে পা...