![]() |
সূর্যসেন দেব |
সূর্যসেন দেব
“পৌষ তদের ডাক দিয়েছে, আয়রে চলে আয় আয় আয়
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়” ---
হেমন্তের পাকা ধানের ফসলে ভরে উঠে গৃহস্থের ডালা। উঠানে গোলা ভরা ধান দেখে খুশিতে মেতে উঠে চাষীদের মন। চাষী বধূরা ঢেঁকিতে ধান ভানে মনের আনন্দে। নতুন চালের গন্ধে ম ম করে সারা বাড়ি, সারা গ্রাম। শীতের শিশির ভেজা সকালে সোনালি রোদের উষ্ণতার আমেজ, পাখিদের কূজন আর শিমূল বকুল নানা রঙের ফুলের বাহারে প্রকৃতি যেন নবরূপ লাভ করে। খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে শীতের এই সময় হয়ে উঠে আরো আনন্দময়। নানারকমের নতুন চাল আর মাঠ ভর্তি শাক-সব্জি, খেজুর গুড় বাঙালির জিভে জল আনে। শীতকাল মানেই প্রচুর খাওয়া-দাওয়া। মাছে-ভাতে বাঙালির মিষ্টি প্রীতিও বিশ্ববিখ্যাত। শুধুই কী মাছ-ভাত আর মিষ্টি! পিঠার প্রতি বাঙালির দুর্বলতাও সকলের জানা। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাদ্য পিঠা। পৌষ মাস আর পিঠা যেন সমার্থক। একটি বাংলা প্রবাদে পাই- ‘পান-পানি, পিঠা / শীতের দিনে মিঠা।’ অর্থাৎ শীতের দিনে পান আর জলের মতো পিঠাও খেতে খুব মিষ্টি হয়। পৌষ মাস এলেই বাঙালির রান্নাঘরে ম ম করে পিঠার গন্ধ। বাঙালির অন্যতম প্রিয় খাদ্য পিঠা। সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে এসেছে পিঠা শব্দ। অভিধানে পিঠা শব্দের অর্থ হিসেবে পাওয়া যায়- ক্ষীর চালগুঁড়ো নারকেল প্রভৃতি সহযোগে প্রস্তুত মিঠাই বিশেষ। পিঠার সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় কঠিন। তবে পিঠা বলতে আমরা বুঝতে পারি – আটার লেচিতে পুর ভরে বা না ভরে বানানো এক প্রকার খাবার। পিঠে চার উপায়ে তৈরি করা যায়- পোড়া, ছাঁকা, সিদ্ধ (জলে কিংবা জলের ভাপে) বা ভাপা পিঠা আর তেলেভাজা। চালের গুঁড়া, নারকেল, তিল, খেজুর গুড়, দুধ ইত্যাদি দিয়ে ভাপা পিঠা বানানো হয়। মালাপোয়া, পাটিসাপটা, পুলি, কুলি ইত্যাদি তেলেভাজা পিঠার উদাহরণ। অনেকে তেলেভাজা পিঠাকে পাকান পিঠা বলে থাকে। ভাঁপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, নকঁশি পিঠা, কুলিপিঠা, নানারকমের পুলিপিঠা, আলুপিঠা, সরা পিঠা, চুঙ্গাপিঠা, তালের পিঠা ইত্যাদি বাঙালির উল্লেখযোগ্য প্রিয় পিঠা। শুধুমাত্র পৌষসংক্রান্তি নয় বছরের অন্যান্য সময়েও পিঠা খাওয়ার প্রচলন আছে। যেমন- ভাদ্র মাসে তালের পিঠা। তবে বেশিরভাগ পিঠা তৈরি হয় শীতকালেই। দেশ ভেদে পিঠার নানা প্রকার রয়েছে।
কবে বা কোন সময় থেকে বাঙালির পাতে পিঠার আগমন ঘটেছে তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। তবে লোকসাহিত্য থেকে শুরু করে রামায়ণ মহাভারত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য হয়ে আধুনিক বাংলা কবিতায় পর্যন্ত পিঠার উল্লেখ পাওয়া যায়।
পিঠা নিয়ে বহু লোককথার সন্ধান পাওয়া যায়। বরাক উপত্যকার একটি পরিচিত লোককথা চড়-চড়ির কিচ্ছা। লোককথাটিতে দেখা যায় যে – একদিন চড়ির পিঠা খাওয়ার ইচ্ছা হয়। তখন চড়া নানারকমভাবে পিঠা বানানোর উপকরণ সংগ্রহ করে। সবশেষে জঙ্গল থেকে বাঘের সাহায্যে লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠা বানানোর জন্য। তবে বাঘ একটি শর্তে সাহায্য করেছিল। বাঘেরও পিঠা খাওয়ার ইচ্ছা। তাই বাঘ বলেছিল পিঠা বানিয়ে বাঘকে খাওয়াতে হবে। চড়া তখন বাঘের কথায় রাজী হয়।এবং বলে বিকেলে তাদের বাড়ি থেকে যখন ধোঁয়া বের হবে তখন যাওয়ার জন্য। কিন্তু লোভ সামলাতে না পেরে চড়া-চড়ি দুজনে সব পিঠা খেযে নেয়। বাঘের জন্য কিছুই থাকে না। শেষপর্যন্ত বাঘ এসে ঠকে যায়। দরিদ্র ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর পিঠা খাওয়া নিয়ে আরেকটি লোককথা প্রচলিত রয়েছে। ওই লোককথাটিতে দেখা যায় যে দরিদ্র ব্রাহ্মণ একিদন যজমানী থেকে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে আসে। হঠাৎ ব্রাহ্মণ ভাবে লুকিয়ে দেখবে যে ব্রাহ্মণী কী করছে। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ব্রাহ্মণ দেখতে পায় যে ব্রাহ্মণী পিঠা বানাচ্ছে। ব্রাহ্মণ তেলে পিঠা ভাজার শব্দ শুনে গুনে নেয় যে ব্রাহ্মণী পনেরটি পিঠা বানিয়েছে। ঘরে আসার পর ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণকে মাত্র তিনটি পিঠা দেয় খাওয়ার জন্য। তখন ব্রাহ্মণ বলে উঠে- চেৎ পিঠা পনের পাতে তিন পাতিলাত বারো। অর্থাৎ পনেরটি পিঠা বানিয়ে পাতে মাত্র তিনটি পিঠা দেওয়া হয়েছে আর বাকি বারোটি পিঠা পাতিলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ব্রাহ্মণের মুখে এমন কথা শুনে ব্রাহ্মণী আশ্চর্য হয় আর ভাবে ব্রাহ্মণের বোধহয় জ্যোতিষ জ্ঞান আছে। তারপর গল্পটি অন্যদিকে এগিয়ে যায়। অনুরূপ একটি লোককথা পাওয়া যায় অসমীয়া লোকসাহিত্যেও।
বাংলার প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতির সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্যে। সাথে খাদ্যসংস্কৃতিরও। আমিষ-নিরামিষ নানা ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন ইত্যাদির বর্ণনা পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন পদে। নানা ব্যঞ্জনের সাথে পিঠারও উল্লেখ পাওয়া যায় সেই খাদ্য তালিকায়। নারায়ণদেব পূর্ববঙ্গ ধারার মনসামঙ্গল কাব্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর পদ্মাপুরাণ কাব্যে বেহুলার বিবাহ উপলক্ষে রন্ধন করেন তারকা। তারকার রন্ধনের তালিকায় পাওয়া যায় পিঠারও-
“আলুবড়া চন্দ্রপুলি অদভুত কাতলা।
ঘৃতে ভাজিয়া তোলে জত মনোহরা॥
লালবড়া চন্দ্রকাতি আর পিঠা রুটি।
দুগ্ধ চুহি পাত পিটা ভরিলেক বাটি॥”
বর লখিন্দরের পাতে আমিষ-নিরামিষ নানা ব্যঞ্জনের সাথে সবশেষে পরিবেশন করা হয় পরমান্ন পিঠা-
“তাহার পাছে আনিয়া দিল পরমান্ন পিঠা।
পাটের ফেসুয়া দেখে আর ধান্য গোটা॥"
পিঠাকে যত্নের সাথে শুধু পরিবেশন করা হয়নি, উল্লেখ করা হয়েছে পরমান্ন বলে। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে সনকার রন্ধনে পিঠার উল্লেখ পাওয়া যায়-
“মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস। দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়স॥
দুগ্ধ পিঠা ভাল মত রান্ধে ততক্ষণ। রন্ধন করিয়া হইল হরষিত মন॥”
মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর বণিক খণ্ডে খুল্লনার রন্ধনে রয়েছে পিঠার উল্লেখ। খুল্লনার রন্ধনের আয়োজনে দুবলা দাসী যায় হাটে বাজর আনতে। সেখানে সমস্ত উপকরণের সাথে পিঠার কথা মনে রেখে আটা ক্রয় করতে দেখা যায় দুবলাকে-
“নির্মাণ করিত পিঠা বিশ দরে কিনে আটা
খণ্ড কিনে বিশা সাত আট”
স্বামীর আদেশে খুল্লনা আমিষ-নিরামিষ নানা ব্যঞ্জনের পর রন্ধন করেন পিঠা-
“রান্ধএ পাকাল ঝষ দিআ তেঁতুলের রস
খিরী-রান্ধে জাল করি ভাটি
কলা-বড়া মুগ-সাঙলি খিরোসা খিরের পুলি
নানা পিঠা রান্ধে অবশেষে”
ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্যে গোলাহাট পালায় বারবনিতা সুরিক্ষার রান্নায় পিঠার উল্লেখ আছে-
“সঝাল বক্কাল কত মিছরি মিশাইয়া।
দুগ্ধ মারি ক্ষীর করি রাখে জুড়াইয়া॥
উড়ি চেলে গুড়ি কুটি সাজাইল পিঠা।
ক্ষীর খণ্ড ছানা ননী পুর দিয়া মিঠা॥
ঘৃতপক্ক লুচি পুরি নাগর উদ্দেশে।
অপূর্ব্ব উড়ির অন্ন রান্ধে অবশেষে॥”
ময়মনসিংহ গীতিকার ‘কাজলরেখা’ রূপকথায় পিঠার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়-
“জোরা কইতর রান্ধে আর মাছ নানা জাতি।
পায়েস পরমান্ন রান্ধে সুন্দর যুবতী॥
নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত।
চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রের আকরিত।
চই চপড়ি করে কন্যা সুবর্ণের থাল॥
ক্ষীরপুলি করে কন্যৈ ক্ষীরেতে ভরিয়া।
রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া॥
উত্তম কাঁঠালের পিড়ি ঘরেতে পাতিল।
ছিটা ছড়া দিয়া কন্যা পরিচ্ছন্ন কইল॥”
মলুয়া পালায় অথিতি অভ্যর্থনা পর্বে মাছ, শুটকি মাছ, ভাজা বড়ার সাথে রয়েছে নানান রকমের পিঠাও-
“শুকত খাইল বেনুন খাইল আর ভাজা বরা।
পুলি পিঠা খাইল বিনোদ দুধের শিস্যায় ভরা॥
পাত পিঠা বরা পিঠা চিত চন্দ্রপুলি।
পোয়া চই খাইল কত রসে চলচলি॥”
বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খণ্ড কবিতার আদর্শ প্রবর্তন করেছিলেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ‘পৌষপার্ব্বণ’ কবিতায় পিঠার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়-
“তাজা তাজা ভাজাপুলি ভেজে ভেজে তোলে।
সারি সারি হাঁড়ি হাঁড়ি কাঁড়ি করে কোলে॥
কেহ বা পিটুলি মাখে কেহ কাই গোলে।
আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে পিটেপুলি অশেষ প্রকার॥
বাড়ী বাড়ে নিমন্ত্রণ কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার ধন্য তোর খেলা॥”
পিঠের প্রতি ভালোবাসা তথা আকর্ষণের কথা পাওয়া যায় কবি সুনির্মল বসুর ‘পৌষ-পার্বণ উৎসব’ কবিতায়। তিনি লিখছেন-
“পিঠে পিঠে পিঠে
ভাবছি যতই খাবার কথা
লাগছে ততই মিঠে
পিঠে পিঠে পিঠে।
ঐ চড়েছে রসের ভিয়ান,
আসছে রসের ছিটে
পিঠে পিঠে পিঠে।”
নানান রকমের পিঠের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় সাম্প্রতিক কালের কবি অতনু দত্তের ‘পৌষ পার্বণ পিঠে পুলি’ কবিতায়। পিঠের বর্ণনায় তিনি লিখছেন-
“হরেক ঘরেতে দেখ পিঠের রকমটা,
কোথাও পুলির চল কোথা পাটিসাপটা।
কোথাও চিতৈ চলে কোথাও বা আস্কে।
মালপোটা ভাজা হলে ভরে ফেলো বাস্কে।
পিঠে তো থাকেই সাথে রয় পায়েশান্ন,
খায় তা গরীব আর চাখে মহামান্য।”
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। তবে পিঠা-পুলির ঐতিহ্য হারিয়ে যায় নি। পিঠা বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে বাঙালির পিঠা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। নাগরিক সংস্কৃতিতেও পিঠেপুলি স্থান করে নিয়েছে ব্যাপকভাবে। পিঠেপুলির চাহিদা বাড়ছে। পিঠেপুলি ছাড়া বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি অপূর্ণ। তাইতো সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে সিনেমা সবেতেই পিঠা প্রসঙ্গ এসেছে নানভাবে। বাংলা চলচ্চিত্রে বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভাণু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘মাসিমা মালপোয়া খামু’ খাদ্যরসিক বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা রয়েছে।
বেশ লাগল সূর্য লেখাটি।
উত্তরমুছুন