প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১) |
শিলচর শহরের বড় একটি শপিংমলে কাজ করে সনকা। লাঞ্চের পর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত
ক্যাশ কাউন্টার সামলানোর দায়িত্ব তার। তারপর ভাওয়াল পয়েন্ট থেকে অটো বা ই-রিক্সা
করে বাড়ি ফেরা। তারাপুর ওভার ব্রিজের পাশের একটি গলিতে থাকে সে। সেন্ট্রাল রোডের মত
জায়গায় রাত আটটা কোন বেশি রাত নয়। একটা না একটা গাড়ি পাওয়া যায়ই। কোন কোন দিন
তো মল থেকে বের হতে নয়টা বেজে যায়। তখনও গাড়ি পেতে অসুবিধা হয় না। নিত্যদিনের যাতায়াত,
তাই এখানকার অটো বা ই-রিক্সা চালকদের সাথে মোটামুটি মুখ চেনা
হয়ে গেছে তার।
অটোয় যেতে এমনিতেই কমফোর্ট ফিল করে না সনকা। তারপর রাতের বেলা,
তাই যতটা সম্ভব সে চেষ্টা করে ই-রিক্সায় যাওয়ার জন্য। অটোর
ভেতর আগে থেকেই কোন প্যাসেঞ্জার বসে আছে তা বুঝা যায় না। একজন মেয়ে হিসাবে হুট করে
অটোতে উঠে পড়লে অনেক সময় অস্বস্তিতে পড়তে হয়। তাছাড়া সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘেঁষাঘেঁষি
করে অটোতে বসাও অনেকটা বিরক্তিকর। তাই ই-রিক্সায় যেতেই সে পছন্দ করে বেশি। আরেকটি
মজার ব্যাপার হল আজকাল অনেক ই-রিক্সাতেই ছোট ছোট স্পিকারে কম সাউন্ডে সুন্দর সুন্দর
গান বাজে। একদিন এমনই একটি ই-রিক্সাতে উঠেছিল সনকা। ভাওয়াল পয়েন্ট থেকে তারাপুর যেতে
যেতে যে কয়টি গান শুনেছে সে সব কয়টিই নাইন্টিজের, তার প্রিয় গায়ক কুমার শানুর গাওয়া। তারপর থেকে কেন জানি রোজই
সেই ই-রিক্সাতেই উঠে বসে সে। প্রয়োজনে অন্য প্যাসেঞ্জারের জন্য পাঁচ দশ মিনিট অপেক্ষা
করেও।
শ্রেণীবিশেষে মানুষের আচরণ ভিন্ন হয়। ফুটপাতের দোকানদার বা গাড়ির ড্রাইভার,
টিটকিরি মারার ব্যাপারে ওদের জুড়ি মেলা ভার। কোন বিষয়ের মধ্যে
ব্যঙ্গ করার মত খোরাক পেলে ওরা ভীষণ নির্লজ্জ হয়ে যায়। সারাদিনের ক্লান্তির পর ই-রিক্সায়
যাওয়ার পথে ফুরফুরে হাওয়া গায়ে মেখে কুমার শানুর কন্ঠে গান শোনার লোভে সনকা ওই ই-রিক্সায়
প্রতিদিন উঠে বলেই অন্যান্য ড্রাইভাররা তা নিয়ে টারেটুরে অনেক ব্যঙ্গোক্তি করে,
তা সে খুব টের পাচ্ছে কয়েকদিন থেকে। তাছাড়া সনকা আরেকটা জিনিস
খেয়াল করেছে ইদানিং সে ই-রিক্সাতে ওঠার পর অন্য প্যাসেঞ্জারের আর অপেক্ষা করা হয়
না। ড্রাইভার সোজা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। তবে কি ড্রাইভারটিরও কোন বদ মতলব আছে
মনে?
সে নিজে কি অন্য ড্রাইভারদের কাছে সনকাকে নিয়ে কিছু বলেছে?
ছেলেটিকে দেখে বা ওর ব্যবহারে এমন যদিও কোন দিন মনে হয়নি তবে
আজ ওকে জিজ্ঞেস করতেই হবে সে কথা।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শিলংপট্টির মোড়ে আসার সাথে সাথেই ড্রাইভারটি বলল- ‘আমার নাম জিতেন। সবাই জিতু বলে ডাকে। গ্রেজুয়েশন
কমপ্লিট করলেও মার্কের শতাংশ কম থাকায় কোন চাকরি জুটাতে পারিনি এখনও। তাই বাধ্য হয়ে
এই ই-রিক্সাটি কিনলাম।’ সনকা আগে থেকেই মুড বানিয়ে রেখেছিল ওকে
কড়া দু কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে ওর এসব কথা বার্তায় ধৈর্যের ছুটি ঘটল
তার। বলল,
আমাকে এসব কথা কেন বলছো? স্ট্যান্ডে অন্য ড্রাইভারদের কাছে আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলেছ
নাকি?
জিতু কিছু সময় চুপ থাকল, তারপর ই-রিক্সার গতি কিছুটা কমিয়ে বলল- 'আমি তোমাকে স্কুল জীবন থেকেই চিনি। মাস দুয়েক একই স্যারের বাড়িতে
টিউশন পড়েছিলাম আমরা। এই কথাগুলি গল্পের ছলে একজনকে বলেছিলাম এবং তখন থেকেই ওরা এরকম
আচরণ করছে। মনে করে দেখ, একদিন স্যারের বাড়ির কাঠের সিঁড়ি থেকে তুমি পড়ে গিয়েছিলে
এবং শুধুমাত্র আমি দেখেছিলাম ঘটনাটি। তুমি বলেছিলে কাউকে না বলার জন্য। আমি আজও তোমাকে
ছাড়া অন্য কাউকে বলিনি সে কথা।' হঠাৎ কেন জানি সনকার মনে কষ্টের অনুভূতি হল। কোথায় ভেবে রেখেছিল
তাকে বকাঝকা করবে, অথচ এখন মনে হচ্ছে যেন সে তার মন ছুঁয়ে আছে অনেক কাল। জানতে
ইচ্ছে করছে, সেদিনের পর থেকে সে আর স্যারের বাড়িতে আসেনি কেন?
কিন্তু সেকথা আর বলা হল না তাকে। ই-রিক্সা ওভার ব্রিজের কাছে
এসে কখন যে থেমেছে সনকা খেয়ালই করেনি যে!
ওভার ব্রিজের উপর থেকে ভেসে আসছে কুমার শানুর গান-
পহেলি নজর মে তুমহে দিল দিয়া হে, সিসে সা নাজুক য়ে দিল হে হমারা ... শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে ই-রিক্সাটি,
তার চালক যেন সনকার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায় অনন্তকাল।
অথচ সাহস করে দু পা এগিয়ে এসে হাত ধরতে পারছে না তার। তাই চুপিসারে,
আড়ালে আবডালে ফলো করছে তাকে। ব্রিজের নিচে দিয়ে হেঁটে যাওয়া সনকার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে উঁকি
মেরে দেখে একবার।
খুব ভালো লেগেছে
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা
মুছুন