- সপ্তমিতা নাথ
শুভেচ্ছার জোয়ারে ভাসছিল সেদিন মেয়েটি। সবে মাধ্যমিকের
ফলাফল বেরিয়েছে। এই উষ্ণ অভ্যর্থনার উষ্ণতা সহ্য করে উঠতে পারে নাই , বিশেষ করে চোখ দুটি, রক্তিম ঝলসানো চোখে ভেসে উঠেছিল অতীতের ছেঁড়া, ফাটা, ভাঙ্গা কালো পর্দার স্মৃতি। গোটা উপত্যকার ছোট বড়
সংগঠন ব্যক্তি বিশেষ আজ প্রতিভার পাশে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু প্রতিভা কি চায়? প্রতিভার কী চাওয়া উচিত বা অনুচিত সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আত্মবিশ্বাসটুকু
গড়ে ওঠার আগেই দুমড়ে মুছড়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল তার শৈশব। সে আর
কেউ না তারই নিজের পিতা । প্রতিটি
মেয়েরই শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথম নায়ক তার
বাবা, কিন্তু কেন প্রতিভার ক্ষেত্রে তা বিপরীত! কেন তার
বাবা নায়ক না হয়ে খলনায়ক এর প্রতিছবি হয়ে আজ চোখের অশ্রু হয়ে ভেসে গুলিয়ে
যাচ্ছেন তার এই খুশির দিনে?
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন কক্সা তিন এ, রোজ রাতের মতই সেই রাতও কালো ছিল কিন্তু নেমে এসেছিল
অঘোর অমবস্যা, প্রতিভার জীবনে। প্রতিবারের মত
মদাসক্ত বাবা ঘরে এসে মাকে প্রতিদিনের নিময়ের
প্রহার সেরে বিশেষ করে যে কাজ
সম্পাদন করলেন সেটি হলো প্রতিভার সমস্ত বইপত্র উনুনে দিয়ে জ্বালিয়ে ফেলা। সেদিন থেকেই শুরু হলো প্রতিভার
জীবনের পিছিয়ে যাওয়ার উন্নতির দিনগুলো।
রোগাক্রান্ত মা আর বাবাকে নিয়ে সংসার। বাবার সিদ্ধান্তই
সর্বোপরি। আর আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ? সে তো আগে থেকেই ছাপ নিয়ে বসে আছে
প্রান্তিকের, কাজেই প্রতিবাদ তো প্রশ্নই ওঠে না।
এ তো এক স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন ছবি এই সমাজের। ধীরে ধীরে বয়স বাড়তে থাকে। সময়ের টানে হঠাৎ একদিন সার্ভে
করতে এসে শিখা ম্যাডামের হাতে পড়ে যায় প্রতিভা। সরকারি কর্মজীবী, শিক্ষা বিভাগের বিশেষ প্রশিক্ষণ সেন্টারের প্রশিক্ষক।
শিখা মেয়েটিকে দেখেই তার খোঁজ খবর নিলেন এবং তার ইতি বৃত্তান্ত জেনে তার মা এর
কাছে অনুমতি চাইলেন। মেয়েটিকে তার বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু অক্ষম মা পিতার অনৈতিক কাজের ভারে
আড়ষ্ট। সেখানে বাবাকে না জানিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আস্বস্ত করলেন শিখা
ম্যাডাম প্রতিভার মা প্রণতিকে।
প্রতিভার জীবন শিখার আলোতে আলোকিত হতে শুরু হলো। ব্রিজ কোর্স শেষ করে বয়স অনুযায়ী ক্লাসে ভর্তি হলো শিক্ষার অধিকার আইনের আওতায়। কিন্তু নিয়তির খেলা অন্য এক গল্প লেখার ফন্দি আঁটছে। যার ভয় ছিল সেই বিপত্তি ঘটলো। মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে সে সংবাদ বাবার অগোচরে থাকলো না । তারপর ঝরাক্রান্ত এক রাতের তুমুল সংঘাতের পর এবার মা ও মেয়ে গৃহহীন এবং আশ্রয় হলো মামার বাড়িতে।
কিছুদিন বেশ ভালোই কাটলো তারপর শুরু হলো ভাইয়ের দৈমাত্রিক
ব্যবহার । ভাইয়ের পরিবারে দিদির অতিরিক্ত
খরচের বোঝা কে বইবে? অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা বাবদ টাকা
কোথা থেকে আসবে? জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে ঢালের মত
খাড়া শিখার কাছে গেল প্রতিভা। তবে এবার অনেকটাই শক্ত পোক্ত মানসিকতা, যেকোন পরিস্থিতিতেই পড়া চালিয়ে যাবে । শিখার মনোবল
যেন ফোঁয়ারার মতো উচ্ছাসের সাথে বেড়ে গেল সেদিন, যা চেয়েছিল তাই বুঝি হলো। সে দেখতে
পেয়েছিল প্রতিভার মধ্যে অঙ্কুরিত
হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের বীজ।
প্রতিভার জীবনের আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্ভুদ্ব করলেন
শিখা ম্যাডাম। বললেন ‘এবার তোর পড়াশোনা সাথে সাথে সাবলম্বী হতে হবে।’ ব্যবস্থা কি? ‘সেটা আমি করে দিচ্ছি, ছোট ছোট ছাত্রদের পড়াবি আমি সে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি’।
শুরু হলো নতুন যাত্রা কিন্তু নিয়তি আরো কিছু চাইছে প্রতিভার কাছ থেকে। দিন
দিন অবহেলা বাড়তে থাকলো মামার বাড়িতে। প্রতিভা এতদিনে অনেক শক্ত, তাই শিখা ম্যাডামের পরামর্শ নিয়ে আত্মীয়তার যবনিকার
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো প্রতিভা। মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল অজানা ঠিকানায়। ছোট
একখানা ঘর ভাড়া করলো। এবার দায়িত্বও কর্তব্যের ভাড়
অনেকটাই যা সামলাতে শুধুমাত্র ছাত্র
পড়ানো দিয়ে সম্ভব নয়। কারণ যে ছাত্রগুলো পড়াতো তারা তো সেই প্রান্তিক সমাজেরই। কাজেই আর্থিক সহায়তায় বা
পারিশ্রমিক খুবই সামান্য। বড় বাবুদের দ্বারস্ত না হলে মায়ের ঔষধ, ঘর ভাড়া ও দুজনের পেট ভরে দুবেলা খাওয়া হয়তো সম্ভব
নয়। অবশেষে বাধ্য হলো প্রতিভা বাসন ধোওয়া ও কাপড় কাঁচার কাজে নিজেকে নিয়োজিত
করতে, বড় বাবুদের ঘরে। সকালে কাজ সেরে স্কুলে যায় ও দুপুরে মা এ ঝি ত্র দুটা
খেয়ে বসে পড়ে ছাত্র পড়াতে। কথায় আছে আলস্যই দৈন্য দীনের প্রসূতি ও পরিশ্রমই
সফলতার সোপান। সকলের সহায়তা ও সহযোগিতায় প্রতিভা বড় কলেজে ভর্তি হলো।
আজ বিফলতার সাথে সমরযুদ্ধে জয়ী
প্রতিভা কৌশল শিখে গেছে বিপদের সাথে কিভাবে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়। তাহলে কি
সে সফল? তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলির পেছনে যারা রয়েছেন তবে কি তাদের ধন্যবাদ জানানো দরকার? নাকি বয়সের আগে প্রাপ্তমনস্ক হয়ে যাওয়ার জন্য
কিংবা তার শৈশব কেড়ে নেওয়ার জন্য তাদের দোষারোপ করা উচিত? আজ মানসিক ভারসাম্য সামলাতে পারছিল না, প্রতিভার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা বইছে। ঘরের এক কোনাতে লুকিয়ে রেখেছে প্রতিভা নিজেকে! যখন
বাইরে বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি-বিশিষ্ট সবাই দাঁড়িয়ে
আছেন ওর সাথে দেখা করে সাহায্যের হাত বাড়াতে। পত্রপত্রিকা সংবাদ মাধ্যম সব
কিছুতেই প্রতিভা তার সমরযুদ্ধের কাহিনী ও মাধ্যমিকের ফলাফলের জন্য শীর্ষে।
প্রতিভার প্রদীপ, শিখার দীপ্তিমা, আলোক না পেলে হয়তো ডুবে যেতো অতল অন্ধকারে । অন্ধকারের সমাবেশে এরকম আরো
অনেক শিখাই আলোকিত করতে পারবে হাটে , দোকানে রাস্তায় রোজ দেখা পাওয়া
বিবর্ণ প্রতিভাগুলোকে। হয়তো বা যদি কখনো হঠাৎ ছিটকে পড়ে
কোন প্রদীপের অল্প আলোক শিখা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন