শুক্রবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

শতদল আচার্য-র দুটি কবিতা



।।'প্রতাপ' পূজা সংখ্যা ১৪২৫।।

দেশ নেই---শুধু গল্পই থেকে যায়।

আমাদের কোন দেশ নেই
কেবল গল্প আছে।
তেমন কোন ঘর ও নেই
শীত তাপ নিয়ন্তিত আরামপ্রিয় বিছানা
যেখানে নাড়িয়ে জানাবো শরীরের সব ভাষা।

ছোটবেলা থেকে শুনে আসা এক দেশের গল্প
গল্পে ভাসমান মাছ  ভাতে ভাল থাকার গান।

এই যে সব শেষ হয়ে আসার  পরও গল্প থেকে যায়
এখন দেখি গল্পের দেশের মত
আমাদের এক গল্প এসেছে জীবনে
আমাদের কোন দেশ নেই
শুধু গল্পই থেকে যায়।

...

স্মৃতি

দরজাটা খুলতেই দেখি
দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতি।

একটা সময় দ্রুত  দৌড়ে গেল
সমস্ত  ওয়েব ল্যাংথ জুড়ে
               একটা ছন্দপতন ।আর
ভেসে এলো,
                   বিলায়েত খানের
                      সেতারের শব্দ।

রাকেশ দাস এর দুটি কবিতা



অন্তহীন ভাবনা


চুকিয়ে দিয়ে সকল খেলা
            ধ্রুবতারার দেশে যাব,
মানস লোকে আপন-ভোলা
         শূন্য দোলায় দোল খাব।

ক্লান্ত পথিক শূন্য হাতে
          সসীম খেলায় ক্ষান্ত হব,
পাগল পারায় গতির নেশায়
            অনন্তকাল বিভোর রব।

এবার আমি চুকিয়ে দিয়ে
          ভূবন ঘরের পাওনা দেনা,
তিমির মাখা আলোক লোকে
                   মত্ত হয়ে দেব হানা।

থামব না কোনো আঘাত পথে
                 পূর্ন করব মন-বাসনা,
এ যে আমার  স্বাধীন মনের
               এক অনন্তহীন ভাবনা।

...


আকাশ মাটির যুগলবন্দী


মন পবনের নাও ভাসিয়ে বিশেষ কারো খবর
অসীম গাঙের সসীম তীরে নিয়েছি আজ জবর।

পাইনি খুঁজে অচিন পাখির নাগাল
মন মাঝি তার বৈঠা বেয়ে চলছে চিরকাল।

তোমার আমার খেলার মাঝে-কাজের ফাঁকে
ময়না দ্বীপের অচিন নারী  আমায় ডাকে।

ভাবছি আমি কাজের শেষে সারা বেলা
ভাসিয়ে দেব শ্যামের বাঁশির সুরের ভেলা।

প্রাণের খেলায় মত্ত হয়ে অভিসারে
অসীম পথে পা বাড়াব রাধার মত চুপিসারে।

বৃন্দাবনের পথের ধূলায়-ফুলের দোলায়
কৃষ্ণ-রাধার নবীন বাসর কুসুম মালায়।

ছুটির মাঝেও কাজের ছুটি হয়না আমার কোনোদিন
মনের আকাশ যুগান্তরে আশার দিশায় রঙিন।

নিরুদ্দেশে মাত্রা পথে যাত্রা কবে হবে শুরু
সেই আশাতে বক্ষ আমার করে দুরু  দুরু।

মনের ভিতর অচিন পাখি কখন আসে যায়
পড়লে ধরা হৃদয় শিকল দিব পাখির পায়।

নৃপেন্দ্র দাস এর দুটি কবিতা



চেতনা


হে আমার দরিদ্র শনবিল
হে আমার কাঙ্গাল শনবিল
হে আমার নির্যাতিতা শনবিল
উঠো জাগো নিশী অবসান প্রায়।
চিৎকার করো দুধের শিশুর ন‍্যয়।

মৌন কেন তুমি জননী
মৌন কেন তুমি নির্যাতিতা নারী
মৌন কেন তুমি নব শিশু
মৌন কেন তুমি কিশোর কিশোরী
উঠো জাগো নিশী অবসান প্রায়।
চিৎকার করো দুধের শিশুর ন‍্যয়।

ও আমার জন্মভূমিগো তুমি জাগো
ও আমার শনবিলগো তুমি উঠো
ও আমার চাষা ভাই উঠো জাগো
ও আমার মৎস্যজীবী ভাই উঠো জাগো
উঠো জাগো নিশী অবসান প্রায়।
চিৎকার করো দুধের শিশুর ন‍্যয়।

...


প্রিয় শনবিল


হে সোনার রবি সোনার আলো
সিগ্ধ পরশ তৃষার ভালবাসা।
জাগাও জাগাও হে তুমি
মৌন সমাজের নিদ্রা;
জাগাও নিরাশা মানুষের অন্তরে আশা।

সুপ্রভাতে যেমন শিশির ভেজা আকাশে
সোনালী আলোয় আলোকিত তুমি।
তেমন অসহায় সমাজের অন্ধকার
নিরীহদের জীবনের যত আঁধার
দুরে সরিয়ে দাও নব রবি তুমি।

হে বিচিত্র পৃথিবী সবুজ অরণ্য
তোমার সবুজে শ্যামলে,
ভরিয়ে দাও রাঙিয়ে দাও শনবিল।
তোমরা উঠে এসো হে কৃষক,
তোমরা উঠে এসো হে মৎস্যজীবী
সূর্যের মতো তেজস্ক্রিয় হয়ে
অন্ধকার থেকে এসো বাহির হয়ে।

সুমন দাস এর দুটি কবিতা



ক্ষত

সাতটি দশক আগে ভাগ হলো দেশ
সব ধ্বংস রাজনীতির পাশা খেলায়,  
ক্ষমতার লিপ্সায় ওরা দিল কূটচাল
মানুষও উঠলো মেতে ধর্মের নেশায়।

স্বাধীনতার রব উঠলো যে চারিদিকে
ধর্মের ভিত্তিতেই চাই আলাদা ভূখণ্ড,
রাজনীতির ব্যবসায়ীরা তো হর্ষল্লাসে
নিজের তাগিদে দেশ করলো দ্বিখণ্ড।

পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে অনেকে
ক্ষত নিয়ে নতুন ঠিকানায় দিল পাড়ি, 
কোথাওবা পড়ে রইল সোনার ফসল
কতো কতো জমিদারের দালান বাড়ি। 

কতো স্ত্রীর মুছে গেল সিঁথির সিঁদুরটা
কোল খালি হলো যে অনেক মায়ের,
ভাইটা হারালো প্রিয় ভাইকে চিরতরে
সম্ভ্রম হারাতে হলো কতো যে বোনের।

বুকে ক্ষত নিয়ে নতুন স্থানে নতুন করে
শুরু হল যে জীবনের আরেক সংগ্রাম,
ফের নিজেকে স্বদেশী প্রমাণের পালা
তাইতো ছুটছে অনেকের কালো ঘাম।

পূর্বপুরুষ ক্ষত নিয়ে হলেন বাস্তুহারা
উত্তরাধিকারী আজও তা বয়ে চলছে,
অজানা ভয়ে যে মরছে তিলে তিলে
শেষ ঠিকানাও কি হারিয়ে যাবে পাছে?

সারেনি তো এখনো পর্যন্ত কত জনার
সাত দশক আগেকার ওই পুরনো ক্ষত,
প্রমাণের গ্যাঁড়াকলে পিষ্ট হয়ে ফের কি
নতুন ক্ষত বুকে নিয়ে হতে হবে বাস্তুচ্যুত?

...


অনুকরণ
     

যদি কাউকে করো অনুকরণ
তবে সূর্যকে করো, চাঁদকে নয়।
সূর্যের যে কোনো বদনাম নেই
চাঁদের গায়ে কিন্তু কলঙ্ক হয়।।

চাঁদের পানে পারবে তাকাতে
যতক্ষণ তব ইচ্ছে আছে মনে।
ভরদুপুরে পারবে কি তাকাতে
নীলাভ আকাশের সূর্যের পানে?

নিজেকে গড়তে হবে সেই ভাবে
যাতে কেউ কলঙ্ক খুঁজে না পায়।
প্রতিটি পদক্ষেপে যেন তোমার
সুনামের ঔজ্জ্বল্যতাটুকু ছড়ায়।।

পাছে অনেকেই হিংসায় জ্বলবে
হয়তোবা চাইবে তোমার সর্বনাশ।
বাধা বিপত্তি পিছনে ঠেলে দিয়ে
কাজে হতে হবে সূর্য সম প্রকাশ।।

মেঘের আড়ালে কিন্তু সূর্য হাসে
ছড়ায় যে তার উজ্জ্বল বিচ্ছুরণ।
তেমনি কালো মেঘ দূরে সরিয়ে
গঠন করো তোমার এই জীবন।।

প্রসেনজিৎ দাস এর দুটি কবিতা



প্রতিদান কী দিয়েছ


ভাই কী দিয়েছ প্রতিদান তাঁদের রক্তের বদলে
যাঁরা দিয়েছে প্রাণ  আত্মাহূতি দেশ গড়ার
তাঁদের আদর্শ মেনে করি না সম্মান
অবহেলিত তাঁরা আজ আমাদের সবার  অন্তরে
দিনের আলোতে তাঁদের স্ট্যাচুতে  কুসুমদাম পড়িয়ে
আর রাতের অন্ধকারে নোংরা আবর্জনা
ফেলে দিলে তাদের ওপরে
তাদের রক্ত বয়ে যাওয়া রক্তনদীতে
তোমরা নিজেরাই দিলে শবদেহ ভাসায়ে
মনের মহানন্দে সময় গুণে।
          
...


অতীত হয়ে গেছি


আমাকে তুমি অন্য কিছু জিজ্ঞেস করো
কিন্তু সম্পার কথা নয়।
সে এখন দালান বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করে।
সে প্রতিদিন বাস্তব স্বপ্নের সাথে খেলা করে
আমাকে মনে রাখার মতো তার  সময় নেই হাতে 
আমি তো এখন অতীত হয়ে গেছি ।
আমার ভালোবাসার স্মৃতির বোঝা
এখন দাঁড়িয়ে আছে অর্ধ পুড়িয়ে ফেলা
কিংবা ছেড়া খাতার পুরনো মলাঠের মতো
রাস্তা, নর্দমার নোংরা, আবর্জনার ভেতরে
ঘুমিয়ে আছে চিরকালের জন্যে।
তার অন্তরে কি আর ফোটে উঠবে?
আমার প্রথম জীবনে দেওয়া লাল গোলাপ।

আব্দুল হালিম বড়ভূইয়া-র দুটি কবিতা



এক গুচ্ছ কাশ

পথের শেষান্তে একগুচ্ছ কাশ

খুলে দিল তার ফুটন্ত দুয়ার।

অবুঝ আগ্রহে প্রকৃতির বুকে

সাদা পালক তুলে আনন্দ করে।

এক খুশীর বার্তা ছড়ায়ে দিয়ে---

শরৎরাণীকে দেয় আভরণ।

কর্কশদেহে তুলো সাজিয়ে নেয়,

মনুষ্যলোকে মুক্ত ঝরা চাদরে।

বাতাসের দোলায়, জগৎ ভোলায়

আগমণী বার্তার আবেগ রসে।

শুভ্র মনোহর এই কাশফুল

আশ্বিনের আঙিণায় হিমের পরশ।

...


শিউলি


নূতনের গন্ধে খুঁজে বেড়াই---

কী জানি ; কী একটা উদ্যম এসেছে,

আকাশের নীলিমায় ঘন মেঘ;

বাতাসও একটু ভার।

গরমের সকাল-সন্ধ্যায়; শিশির কণা,

গাছের ডালে শিউলি ফুটেছে

মুকুলেও গেছে ভরি।

মাটির টানে উপচে পড়া

লাল-সাদা দেহ নিয়ে কী বাহার!

অশেষ মগ্ন আনন্দলোক,

শিউলি ফুটে গেছে এই ভেবে।

বুধবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৯

বাবুল চন্দ্র দেব এর দুটি কবিতা



আইনের চোখে কালো কাপড়

যখন দেখি শতোর্ধ বৃদ্ধ ভারতীয় কিনা
প্রমাণ দিতে আদালতে ঘন্টার পর ঘণ্টা
বারান্দায় পড়ে থাকেন, তখন জানতে
ইচ্ছে হয়, স্বাধীনতা তোমার বয়েস কত!
ভারত, বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান
শতোর্ধ তো এখনো নয়।

যখন দেখি কাগজের প্রামাণিকতায়
মাকে বন্দি হতে হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে
তখন জানতে ইচ্ছে হয় আইনের কাছে
কোথায় হারিয়ে গেল মানবতা!
একাত্তরটাই সীমারেখা আর পরিচয়?

যখন দেখি ঘরের একমাত্র সম্বল
ছেলেটির খোঁজাখুঁজি চলে আর
নদীর জলে ভেসে উঠে পচাগলা লাশ
তখন জানতে ইচ্ছে হয় খসড়ার কাছে
প্রাণ নিয়ে খেলার কে দিলো অধিকার!

উন্মাদ উল্লাসে বিজয় কীর্তন যখন দেখি
কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় জনতার
তখন ঘৃণা আর লজ্জায় জানতে ইচ্ছে হয়
এই টাকা দিয়ে করা যেতো না দূর
বেকারত্বের হাহাকার!

ক্রান্ত হও ভাই, ভেঙ্গে দাও সংকীর্ণ যত
মানষিকতার বেড়াজাল, উন্মুক্ত আকাশ
এসো হাতে হাত ধরে মানুষের কথা বলি
উড়াই ত্রিরঙা নিশান ভারত মাতার।
পাঞ্জাব যদি পাঞ্জাবির, বিহার যদি
বিহারির, আসাম যদি আসামির
তবে ভারত দেশটি কার!

প্রাণের গ্রন্থ সংবিধান, জানতে ইচ্ছে হয়
আইনের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য আইন
নাকি জীবন নিয়ে খেলা ভাগ্যবিধাতার।
আইনের চোখে কালো কাপড়
বড় লজ্জার, বড় লজ্জার, বড় লজ্জার!

....

অন্ধ নাচ

বন্যার কান্না ভাসছে এখনো
দুঃসহ জীবন রাত্রিবাস
আর্ত যন্ত্রণা হতাশার মেঘে
তপ্ত,  ক্লান্ত, উপবাস।

ঘৃতের বাতি ধূপ চন্দন
ঢাকে পড়লো কাটি
রঙ, ঢঙ আর সাড়ম্বরে
ভাবের পরিপাটি।

কপালে যার কাল বৈশাখী
উত্তাল সাগরে কিসের ভয়?
জীবন তো আর ঘুমের ঘোরে
অলীক কোনো স্বপ্ন নয়।

তালের পাতার নৌকা দিয়েই
জীবন নদীর পারাপার
দুহাত যাদের কাণ্ডারি হয়
প্রয়োজন কি মহামায়ার!

ক্ষুদার পেটের জ্বালা কি আর
জোড়ায় শিউলি ফুলে
অন্ধ নাচের উন্মাদনা
কাণ্ডজ্ঞান ভুলে।

রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

জয়মণি দাস এর দুটি কবিতা

।।'প্রতাপ' পূজা সংখ্যা - ১৪২৫।।

সরল পাথর

রাস্তার দু-পাশ, লোকটির জানা নেই
সে কোনদিকে ছোটবে?
রাস্তা এখন খুব ব্যস্ত।
আসলে নগরজীবন তো!
সে ছুটছে অনবরত
সে অনন্ত সীমাহীন গতির দিকে ছুটছে
নাগরিক এখন ব্যস্ত
নিজস্বতায় মগ্ন।
এখন প্রকৃতিও খেয়ালখুশি মতো চলে না
চালানো হয়,
আসলে সবই এখন মানুষের মুঠোয়
চলে এসেছে।

স্বাধীনতা বিলাসিতায় মত্ত।
যে লোকটি শহরের রাস্তা পার হতে পারছিল না
আজ সে ফ্লাইওভারে হুন হুন করে চলছে।
লোকটি যন্ত্রে পরিণত হয়েছে,
গ্রামের সরল স্নিগ্ধ জীবন
শিখে নিয়েছে ধান্ধাবাজী।
আসলে মানুষ শিক্ষা নেয় না, দেখে
অনুকরন করে
পাথর হয়ে যায়।

....

ভালোবাসা ভালোবাসে ভালোবসতে

সবুজ পাতা নিচের পাথরকে শিশিরের বিন্দু দেয়
শুষ্ক পাথর
বিন্দুতে মন মিটে  না।
পাথর থেকে শেওলা গজেছে
জলের কণা বেসে যায়
সবুজ গাছের স্রোতে।
পায়ের পাতার সাহায্যে ভেগে আনবার
চেষ্টা করে পাথর
সে খাঁমটি মেরে ধরে রাখে
ছাড়তে চায় না তার অসার জীবনের সাথীকে।

ঝোলে থাকা পাতা আবার উষালগ্নের
কুয়াশার কণা
বারিদ বিন্দু দান করে।

বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

সৈকত মজুমদার এর দুটি কবিতা

।।'প্রতাপ' পূজা সংখ্যা - ১৪২৫।।

আমৃত্যু

আমৃত্যু
তোমাকেই ভালোবেসে যাব,
সেই কম্পিত ঠোঁট আর
চেনা পেলব দেহের ঘ্রাণ
আমায় টানে বারংবার।
আজও উন্মাদের মতন আমি
ছুটে যাই তোমার ডাকে
মৃত্যু জেনেও সেখানে...
তোমাকে পাওয়ার কামনা
এ জন্মে আর গেলো না।

এবারের মতো না হয় চলে যাব,
তবে আরেকটা কথা —
জন্মান্তরবাদ বলে যদি কিছু থাকে
সেই জন্মে আমি তোমাকে আমার
জীবনসঙ্গী হিসাবে চাই , কারণ
এ জন্মে তুমি অন্যের...
তাই  তোমাকে আর পাওয়া হলো না।
কিন্তু , পরের জন্মে তুমি আমার
সেই অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি
প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি...
                                       
....

সবাই উদ্বাস্তু

হে রাজন !
একটু ভেবে  দেখুন,
এ পৃথিবীতে আমরা কেউই 
আগে আসিনি ; এসেছে ভূমি
এবং এখানে অধিকার নেই আমাদের
তথাপি আমরা পৃথিবীতে বসবাস করি।
তাহলে কিসের আপত্তি আপনার ?
               এক খন্ড মাটি নিয়ে ......

ব্রহ্মপুত্র কিংবা বরাক
হাঙরের মতো যখন খায় গিলে তখন
কোথায় থাকে আপনার খবরদারি ??
অন্তরাত্মাকে জিগ্যেস করে দেখুন
কোনো না কোনোভাবে আমরা
                          সবাই উদ্বাস্তু।

মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

আমার কর্মজীবন নিয়ে আমি গর্ববোধ করি



।।রেবতী মোহন দাস।।

সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম আমার । অভাব অনটনের জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর সংসারের কাজে লেগে যাই । এমন কোন কাজ নেই যা করিনি । পড়াশোনা ছাড়ার 6 বৎসর পর আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে 1975 ইং মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করি শ্যামাচরণ দেব বিদ্যাপীঠ শিলচর থেকে । তারপর ইন্টারমিডিয়েট কাছাড় কলেজ থেকে প্রথম বর্ষ পাশ করে দ্বিতীয় বৎসর পরীক্ষা দিতে পারিনি কারণ সেই দারিদ্রতা । লেগে যাই কাজে । গৃহস্থী, মাছ মারা আরো কত কিছু । কিছু দিন পর অবস্থার উন্নতি হল । তখন মনে হল অনেক গরিব ঘরের ছেলে মেয়েরা পিতামাতার অবহেলার জন্য পড়তে পারে না । আমি চেষ্টা করব ওদের জন্য কিছু করতে । আমাদের গ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্রীযুক্ত গোপেশ রঞ্জন দাস মহাশয়ের প্রেরণায় আমাদের বাঘমারা গ্রামের পাশেই এক্স-টি গার্ডেন শ্রমিক 6 নং (আইরংমারা) গ্রাম । বর্তমান আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে দেওয়ালের নিকটে । তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গন্ধই ছিল না, 1977 ইংরেজির কথা । গ্রামের লোকেরা দিবারাত্র সমানভাবে মাদকে আসক্ত ছিল সেই গ্রামে পরপর কয়েকটি সভা করে উনাদের মতামত নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য প্রাথমিক ভেঞ্চার স্কুল স্থাপন করি ।  না ছিল ঘর না ছিল আসবাবপত্র । আমি উনাদের সাথে গিয়ে জঙ্গল থেকে বাঁশ এনে একটি ঘরের ব্যবস্থা করি । ছন বাঁশের ঘর কতদিনই বা টিকবে ? ভেঙ্গেও গেল । তখন গাছ তলায়, গোয়াল ঘরে, মানুষের ঘরের বারান্দায় ক্লাস করেছি । বইপত্র, খাতা, কলম জোগাড় করতে আমার যে কি কষ্ট হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না । তার উপর নেশাখোর মানুষের উৎপাত- 'আমাদের স্কুল লাগবে না' । কিন্তু ওই গ্রামেরই কিছু মুরব্বি আমাকে বলতেন মাস্টারবাবু এদের কথায় কান দেবেন না । অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি প্রায় প্রতিজ্ঞাই করে ফেললাম আমি স্কুল বানাবোই । নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আসলো সেই শুভ দিন, 1983 ইংরেজির পহেলা  অক্টোবর । আসাম সরকার স্কুলটি প্রাদেশিকরন করলো । এর পূর্বে অনেকবার গুয়াহাটি যাওয়া আসা করতে হয়েছে । অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাহায্য পেয়েছি । স্কুলের অবস্থা ভালো ছিল না । তখন ধলাইর বিধায়ক ছিলেন আমার বন্ধুবর বর্তমান আসাম সরকারের বরিষ্ঠ মন্ত্রী শ্রীযুক্ত পরিমল শুক্লবৈদ্য মহাশয় । উনাকে বললাম স্কুল তো হল ঘরের কি হবে ? তখন তিনি এক লক্ষ টাকা দিলেন । একটা পাকা ঘর হয়ে গেল । তখন থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি । স্কুলে শিক্ষক আমি একা । ডি.আই. মহোদয় কে বলে আরো একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হলো । ভালো মতে স্কুল চলছে ।
চাতলা হাওর তথা আশেপাশের বেশ কিছু স্কুল নিয়ে বাঘমারা কেন্দ্র । সম্পাদক ছিলেন শ্রীযুক্ত গোপেশ রঞ্জন দাস । উনার ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য আমাকে বললেন কেন্দ্র সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে । নুতন চাকুরী বয়স কম, এগুলি আমি বুঝিনা । কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে নির্বাচিত করা হলো কেন্দ্র সম্পাদক হিসাবে । দীর্ঘ 18 বৎসর সততার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছি । আসলো 2003 ইং, সর্বশিক্ষা আরম্ভ হলো । সি. আর. সি. সি. নিয়োগ করা হবে । উক্ত পদের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হলো । আমি নির্বাচিত হয়ে তরুতাজাবাড়ি সি. আর. সি. সি. তে নিযুক্তি পেলাম । দীর্ঘ 10 বৎসর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। অনেক ট্রেনিং করেছি ।
ধীরে ধীরে আমার অবসর গ্রহণের সময় এগিয়ে আসতে লাগল ।  2015 ইংরেজির 15 ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিনে আমি একটি সভা ডাকলাম আমার স্কুলে । সেই সভায় শ্রীযুক্ত পরিমল শুক্লবৈদ্যসহ রাজনীতিবিদরা, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্কুলের বর্তমান কর্মরত এবং প্রাক্তন শিক্ষক শিক্ষিকা বৃন্দ, গ্রামের মুরব্বি বৃন্দ সহ সর্বস্তরের জনসাধারণ ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিলেন । আমি সভা কে উদ্দেশ্য করে বললাম -'যে জায়গায় স্কুল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না । সেই জায়গায় সর্বশিক্ষার কারণে তিনটা পাকা স্কুল গৃহ, রান্নাঘর, শৌচালয়, জলের কল সহ সবরকমের সুবিধা তৈরি হয়ে গিয়েছে । দীর্ঘ চাকুরী জীবনে যদি ভুল ভ্রান্তি কিছু করে থাকি তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । এই গ্রামের জনসাধারণ আমাকে দেবতার মতো মান্য করেছে । ওদের সর্বপ্রকার সামাজিক কাজে আমি অংশগ্রহণ করেছি । 48 বৎসর পূর্বে গ্রামের যে অবস্থা বা পরিবেশ ছিল তা আজ আর নেই । প্রত্যেক ঘরের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন স্কুলে কলেজে পড়ছে । সত্যিই যাহা ভালোলাগা এবং আনন্দের বিষয় ।' সভায় বিভিন্ন বক্তা নিজ নিজ বক্তব্যে প্রশংসায় আমাকে ভাসিয়ে দিয়েছেন । সকলের শেষে বক্তব্য রাখেন মাননীয় পরিমল শুক্লবৈদ্য মহাশয় । উনার বক্তব্য বলেন, আজ তো বিদায় সভা নয় তবে কেন এই সভার আয়োজন ? কেহ তো এরকম করেননি আপনি কেন করলেন ? আমি বললাম, কেউ এমন সভা করে না বলেই তো আমি করলাম । আমি আরো বললাম মজুমদার বাজারে একদিনের জন্য একটি প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল, সেই শিবিরে সি. আর. সি. সি., কেন্দ্র সম্পাদক, প্রধান শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন প্রায় 250 জনের মতো । শিবিরে গুয়াহাটি থেকে আগত প্রশিক্ষক মহাশয় প্রশ্ন করেছিলেন -আপনাদের ছেলে-মেয়েরা কি আপনাদের স্কুলে পড়ে না প্রাইভেট স্কুলে পড়ে ? সভা চুপ, কেউ কিছু বলছেন না । আমি দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার আমার ছেলে মেয়েরা সরকারি এল. পি., এম. ই., হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত । তখন প্রশিক্ষক মহাশয় আমার খুব প্রশংসা করেছিলেন । কথাগুলো এই জন্যই বললাম, ব্যতিক্রম আমি সব জায়গায় । তারপর শুক্লবৈদ্যজি আমার জীবনের সব দিক নিয়ে সভায় বক্তব্য রাখলেন, উনার মত বক্তা বলেই বলা সম্ভব । শেষে বললেন আপনি 'ব্যতিক্রমী' বটে । সভার কাজ শেষ ।
তারপর এলো 31 শে আগস্ট 2015 ইং আমার কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার দিন । কি বলবো গ্রামবাসীরা যে কাজটি করলেন তা অবিশ্বাস্য । আমার ডাকা সভার চেয়ে বড় সভা করে সকলকে বুঝিয়ে দিলেন 40 বৎসর পূর্বে যাদের পড়ালেখার বালাই ছিল না, সভ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত অবস্থা তাদের ছিল না আজ সেই গ্রাম কোথায় দাঁড়িয়ে ! সরকারি মানপত্র ছাড়াও ব্যক্তিগত ভাবে অনেকে মানপত্র এবং অজস্র উপাধিতে ভূষিত করলেন আমায় দিলেন নানা উপহার । সভায় ছিলেন আইরংমারা তথা বরাকের গর্ব পরিমল শুক্লবৈদ্যজি, অফিস অথরিটি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এলাকার মুরুব্বীবৃন্দ, জনসাধারণ, প্রাক্তন এবং বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ । উপস্থিত গন্যমান্যরা প্রশংসায় আমাকে ভাসিয়ে দিলেন । আমি নির্ধারিত আসনে বসে চোখের জল ফেলছিলাম আনন্দে। শেষে শুক্লবৈদ্যজি আমার জীবনের নানা দিক, সফল জীবন, সামাজিক চিন্তাধারা, স্কুল গঠন ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বলে বক্তব্য শেষ করলেন ।
সভার কাজ ছল ছল চোখে শেষ হলো । আমার জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম বিদায় যে এত করুন । প্রায় তিন শতাধিক গ্রামবাসী এবং ছাত্র ছাত্রী মিছিল করে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন ।
বিভিন্ন স্কুলে সংবর্ধনা, পেয়েছি ব্লক পর্যায়ের, 5 সেপ্টেম্বর 2018 ইং শিক্ষক দিবসে জেলা গ্রন্থাগারে জেলা ভিত্তিক সম্মাননা পেয়েছি। আমার কর্মজীবন নিয়ে আমি গর্ববোধ করি ।

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১)

প্রচ্ছদ  :  শুভজিৎ   পাল সম্পাদকীয় ......... বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব , দুর্গাপূজা। এই সময়টিতে বাঙালির প্রাণের মিলন , সংস্কৃতি আর ঐতিহ...