রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৮

মহিমাময় 'হিমা দাস'



।।'প্রতাপ' পূজা সংখ্যা ১৪২৫।।


।।পাপ্পন দাস।।

গেল ৩১ আগস্টের কথা।সেদিনের একটা খবর--
'জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ভারতের সোনার দৌড় ধরে রাখলেন অ্যাথলিটরা'-,আমাকে এবং আমার মতো অনেককে স্বস্তি দেয়।আমরা বুঝতে পারি যে,
অ্যাথলিটরা বরাবরের মতো এবারও আমাদের দেশের মাথা উঁচু করেছেন।যতই তাদের আমরা খুব একটা চালকের আসনে না বসাই,গাড়ি কিন্তু ঠিক চালিয়েই যাচ্ছেন তারা।
    এর আগের দিন(৩০ আগস্ট) দুটি সোনা আসে অ্যাথলেটিক্সে। ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতেন ভারতের মেয়েরা।আর সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন অসম কন্যা হিমা দাস।অবশ্য এর আগেই তিনি ৪০০ মিটার দৌড়ে রুপো পেয়েছিলেন।আর তাইতো সেদিন তিনিই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ।ভারত সহ রাজ্যের আম জনতা যদিও বা এ নিয়ে খুব একটা চর্চার দিকে যাননি,কিন্তু ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে তো এ নিয়ে একটা উত্তেজনা ভাব বিরাজ করছিলই।হিমা দাস এর কী হল,এগিয়েছে নাকি মেয়েটা--এরকম কিছু প্রশ্ন তো মুখে মুখে ছিলই।আর সবশেষে দেখা যায় যে,তিনি হতাশ করেননি আমাদের।
   তিনি ছাড়াও পুরুষদের ১৫০০ মিটার দৌড়ে সে দিনের দ্বিতীয় সোনা এনে দেন জিনসন জনসন।আর সে দিনের জোড়া সোনা নিয়ে ভারতের সোনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩। অবশ্য মেয়েদের ৪০০ মিটার রিলে রেসে ভারতীয় দলই সোনা জেতার দৌড়ে গত চার বারই দাপট দেখিয়েছিলেন।উল্লেখ্য যে,এই নিয়ে ২০০২ সাল থেকে টানা পাঁচ বার সোনা জিতল ভারত এই ইভেন্টে। হিমা দাস ছাড়া ভারতীয় দলে ছিলেন এম আর পুভাম্মা, সরিতা গায়কোয়াড় এবং ভি কে বিস্ময়া।
    বলা বাহুল্য,রুপোর পরে এ বার হিমার সোনা জয়ের উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকে অসম।মন্ত্রী কেশব মহন্ত ঘোষণা করেন, অবিলম্বে ধিঙে হিমার মূর্তি বসবে। অক্টোবরে অসমে এসে নিজে হাতে নিজের মূর্তি উদ্বোধন করে বাড়িতে ঢুকবেন সোনার মেয়ে হিমা।
    এ নিয়ে কোনও একটা কাগজে কারো একজনের লেখা আমার চোখে পড়ে।তিনি লেখেন,হিমা দাসের মূর্তি বসানোর খবরটি পড়ে জানা গেল, অসমের জলসম্পদ মন্ত্রী হিমা দাসের মূর্তি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এক শ্রেণির রাজনীতিকের এই এক সমস্যা, তাঁরা অপ্রয়োজনীয় চমক দিতে ভালবাসেন। হিমা ভারত তথা নিজ রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু মূর্তি বসানোর চেয়ে, রাজ্যের আনাচকানাচে হিমার মতো যে অসামান্য অ্যাথলিটরা লুকিয়ে আছেন, তাঁদের খুঁজে বার করে তাঁদের প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করাটাই আসল কাজ।
    তিনি সঠিক বলেছেন।হিমা দাসের মূর্তি বানানোর বিপক্ষে আমি।এদিকে,১৯৬৬ সালের এশিয়ান গেমসে ৮০০ মিটার দৌড়ে সোনা পেয়েছিলেন ভোগেশ্বর বরুয়া। তার পর থেকে অসমে আর এশিয়াড সোনা আসেনি। হিমার দৌড়ে প্রথম থেকে নজর রাখছিলেন তিনি। তিনি হিমাকে দৌড়ের বাইরে আর কোনোদিকে মন না দেওয়ার পরামর্শও দেন। আর সেদিন হিমার নজির ছোঁয়া দৌড় দেখার পরে আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েন এবং বলেন,
'জাতীয় ও এশীয় রেকর্ড করার পরেও আমি অলিম্পিক্সে দৌড়ানোর সুযোগ পাইনি। সেই কষ্ট দূর হল। তিক্ততা মনে করতে চাই না। আমাদের হিমা এক ঈশ্বর প্রদত্ত উপহার। ওকে পরিবার বা প্রশিক্ষকরা তৈরি করে দেননি। আমার বিশ্বাস হিমা অলিম্পিক্সেও দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু অলিম্পিক্সে যাওয়ার পথে অনেক বাধা আসতে পারে। হিমাকেও সব কিছুর জন্য তৈরি হতে হবে। হিমাকে সামলে রাখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের, রাজ্যবাসীর।'
    গত ৭ সেপ্টেম্বর হিমাকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়।
ঘরের মাটিতে ফিরে রাজ্য সরকারের সংবর্ধনা সভায় এক কোটি ৬০ লক্ষ টাকার চেক হাতে নিয়ে হিমা বলেন,'খেলোয়াড়রা আসলে মনপ্রাণ দিয়ে ভাল ফল করতে চায়। কারণ, তারা পয়সার জন্যই খেলে। জানে পদক জিতলেই টাকা পাবে। আজ যেমন আমি পাচ্ছি। আমি নিশ্চিত আমায় এত টাকা পেতে দেখে অসমের অন্য খেলোয়াড়রাও আজ ভাবছে, হিমা যদি দৌড়ে এত টাকা পেতে পারে, আমিও ভাল খেললে তেমনই পাব।'
    তিনি সঠিক কথাই বলেন।সবকিছুর সঙ্গেই টাকা আর সম্মানের একটা সম্পর্ক রয়েছে।আর দুই-ই যদি কোথাও থেকে হাসিল করা যায় তা হলে অদূর ভবিষ্যতে কেউ এতে এগিয়ে যেতে পিছপা হবে না।
আমাদের অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটা অসহ্য ভাব বিদ্যামান।সেই ছেলেবেলা থেকেই মা-বাবা তাদের সব সন্তানদের বুঝিয়ে দেন যে পড়াশোনা করতে হবে,আর এর পর ভবিষ্যতে একটা ভাল চাকরি জোগাড় করে নিতে হবে।কিন্তু সঙ্গে যে আরও অনেক কিছুও জরুরি বা আরও অনেক কিছুর মাধ্যমেও যে এগিয়ে যাওয়া যায় সে দিকে কারোর নজরই নেই।এ সমাজে সবাই যদি শুধু ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনও অফিসের বড় কোনও অফিসার হন,তা হলে একস্ট্রা কারিকুলামের দিকে কার ঝোঁক হবে?এই যেমন আমরা যারা লেখালেখি করি,অন্তত এই অঞ্চলের,
তারা মনে মনে মেনেই নিই যে,লেখালেখির মাধ্যমে আমাদের আর কিচ্ছুটি হাসিল হওয়ার নয়,একটা ভাল চাকরি আমাদের করতেই হবে,আর তা-ই আমাদের তিন বেলা খাবারের যোগান দেবে।আর সবকিছুর পর যদি কিছুটা সময় বেঁচে যায় তা হলে লেখালেখি করতে পারি।কিন্তু এ থেকে যে কিচ্ছু হাসিল হবে,তা ভেবে নেওয়াই অন্যায়।টাকা তো কেউ দেবেই না,নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেই হবে।আর এ জায়গায় যদি হিমার মতো মেয়েদের হাতে এই লেভেলের সম্মান আর টাকা ওঠে তা হলে এর থেকে ভবিষ্যৎ অনেক কিছু পেয়ে যাবে।
    এদিকে,১৯৬৬ সালে ভোগেশ্বর বরুয়ার পর এবার হিমা। একটি সোনা ও ২টো রুপোর পদক।
সেদিন(৭ সেপ্টেম্বর) বেলা ১টায় বিমানবন্দরে পৌঁছন তিনি।সেখানেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল, অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা, ডিজিপি কুলধর শইকিয়া। সেখান থেকে বিরাট কনভয়ে, হুড খোলা গাড়িতে চেপে হিমার সফর শুরু হয়। প্রথমে জালুকবাড়িতে ভূপেন হাজরিকার সমাধিক্ষেত্রে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান।এরপর ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়ামে যান। দৌড়ের ট্র্যাকে প্রণাম করে হিমা বলেন,'এই ট্র্যাকেই আমার দৌড় শুরু। জুন মাসে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের সেরা সময় করেছিলাম এখানে। জাকার্তায় নির্বাচিত হয়েছিলাম। রাজ্যবাসীর স্বপ্ন সফল করতে পেরে ভাল লাগছে।'
   নস্টালজিয়া!আর সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল হিমার হাতে বিশ্ব জুনিয়র অ্যাথলেটিক্সে সোনা, এশিয়ান গেমসে ১টি সোনা ও রুপোর দুটি পদকের জন্য মোট এক কোটি ৬০ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন। অসমের ক্রীড়া দূত হিসেবে দু’বছরের জন্য হিমাকে ৩০ লক্ষ টাকা হওয়ার প্রস্তাবপত্রও দেওয়া হয়।দারুণ একটা বক্তৃতা দেন তিনি। হিমা বলেন,'বাবা স্পষ্ট জানিয়েছেন, অহঙ্কার পতনের মূল। এই যে চুলে রং করেছি, ছেঁড়া জিনস পরেছি দেখে বাবা খুব রেগে গিয়েছে। আমি জানি একটা চোট লাগলে কালকেই আমার কেরিয়ার শেষ। তখন অহঙ্কার নয়, আমার লড়াইটাই অন্যদের পথ দেখাবে।' তিনি আরও বলেন,'বিভিন্ন রাজ্যের পদকজয়ীরা দল বেঁধে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। আমি গেলাম একাই। সঙ্কোচ হচ্ছিল। রাজ্যের ৩০টি জনগোষ্ঠী যদি অন্তত একজন করে ক্রীড়া প্রতিভাকে তুলে আনতে পারে, ১২৬ জন বিধায়ক যদি নিজেদের কেন্দ্র থেকে একজন করেও আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় দিতে পারেন তবে তার মধ্য থেকে অন্তত ১০ জন পদকজয়ী আসবেই। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে পরের বার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।' আর তারপর দৌড়ের পথ দেখানো শিক্ষক শামসুল হক এবং দুই প্রশিক্ষক নিপন দাস, নবজিৎ মালাকারকে ধন্যবাদ দিয়ে হিমা বলেন,'আমায় যাঁরা তুলে এনেছেন তাঁরাও একই সম্মানের দাবিদার।'
    সবশেষে আরও দু-চারটে কথা।অভিনব অভ্যর্থনার মধ্যে ঘরে আসেন হিমা।আর তা তাঁর প্রাপ্যই বটে।কিন্তু সরকার ও প্রাক্তনদেরও ভেবে দেখতে হবে যাতে আস্তে আস্তে করে এরকম আরও প্রচুর হিমা দাস বেরিয়ে আসেন,যা ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের খুব আনন্দ দিয়ে থাকে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পোষ্ট

আকর্ষণীয় পোষ্ট

প্রতাপ : ১৭তম সংখ্যা (পূজা সংখ্যা - ১৪৩১)

প্রচ্ছদ  :  শুভজিৎ   পাল সম্পাদকীয় ......... বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব , দুর্গাপূজা। এই সময়টিতে বাঙালির প্রাণের মিলন , সংস্কৃতি আর ঐতিহ...