। আরতি দাশ ।
মানব জাতির অস্তিত্ব এবং তার ভবিষ্যতের জন্য নিরলস সাহিত্যচর্চা যে কত জরুরি তাই উঠে এসেছে গত রবিবার মালিনীবিল হংসবীণা ক্লাব প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক আলোচনা সভায়। কবি শৈলেন দাস সম্পাদিত 'প্রতাপ' সাহিত্য পত্রিকার উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিক, শিল্পী এবং প্রবুদ্ধ নাগরিকরা খোলা মনে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেন এবং সাহিত্যই যে পীড়িত মানুষের পরম নিশ্চিত আশ্রয় হতে পারে তার উল্লেখ করেন।
জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী বারীন্দ্র দাস কর্তৃক উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশনের পর তরুণ আইনজীবী সুবীর দাস অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। শহর সংলগ্ন হওয়া সত্ত্বেও (পুরসভার অন্তর্ভুক্ত) এই অঞ্চলটি খুবই পশ্চাদপদ, খেটে খাওয়া দিনমজুরদের আবাসস্থল। এই অঞ্চল থেকে শৈলেন দাস যে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন তার পেছনেও রয়েছে পিছিয়ে পড়া, অজ্ঞাত, উপেক্ষিত লোকদের আশা-আকাঙক্ষা তুলে ধরা এবং গ্রামগঞ্জ মফস্বলের লেখক-লেখিকা, যাঁরা প্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাঁদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা।
প্রখ্যাত কবি-সাংবাদিক অতীন দাশ এবং ছবি গুপ্তা কর্তৃক সাময়িকীটির আনুষ্ঠানিক উন্মোচনের পর উপস্থিত সুধীবৃন্দ তাঁদের বক্তব্য রাখেন। বয়োবৃদ্ধ কবি ছবি গুপ্তা অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে এসেছেন শৈলেন দাসের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত ভালভাসার টানে। তিনি জানান, নিতান্ত কৈশোর থেকে শৈলেনকে বড় হতে দেখেছেন এবং তাঁর কাব্যচর্চার সঙ্গে প্রথম থেকেই তিনি পরিচিত। সুতরাং শৈলেন দাস কর্তৃক সম্পাদিত পত্রিকা প্রকাশ তাঁর জন্য খুবই আনন্দের বিষয়। একই অনুভূতি ব্যক্ত করলেন অনুষ্ঠানের মুখ্য অতিথি কবি-সাংবাদিক অতীন দাশ। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানটি খুবই ব্যতিক্রমী। বই-পুস্তক বা পত্রপত্রিকার প্রকাশ অনুষ্ঠান সাধারণত হয়ে থাকে শহরের কয়েকটি বিশেষ চিহ্নিত স্থানে-বাঁধাধরা গতানুগতিক পরম্পরায়। কিন্তু এখানে শহরে থেকেও সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে, উন্মুক্ত মাঠে মেরাপ বেঁধে চন্দ্রাণ্ডপ টাঙিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। উপস্থিত হয়েছেন সর্বশ্রেণির মানুষ। শহরের পোশাকি ভদ্রলোকরাই শুধু নন, খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরাও মঞ্চ আলোকিত করে বসেছেন। তিনি বলেন, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ এই ভঙ্গুর ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য নিশ্চিতভাবেই এক সুসংবাদ। সাহিত্য মানববিদ্যা চর্চার হাতিয়ার। মানুষ যত সাহিত্য চর্চার প্রতি আগ্রহী হবে, ততই বিত্ত-বাসনার অন্তহীন ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্তি পাবে। হৃদয়বৃত্তি থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি হয়, মানুষ এই চর্চা থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে ততই দানব হয়ে উঠছে। প্রসঙ্গত, দিল্লির গণধর্ষণের কথাও উঠে আসে। তিনি রাষ্ট্রনায়কদের অভিযুক্ত করে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পরিকল্পিতভাবে দেশের মানুষকে নীতিহীন, লম্পট, প্রতারক এবং পরস্বাপহরণকারী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষা বা নীতিপাঠ এখন বাধ্যতামূলক নয়, সন্তানদের অর্থ উপার্জনকারী রোবট হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এই ভোগবাদী মানসিকতায় নীতি, নৈতিকতা, সংবেদনশীলতা কোনও কিছুরই স্থান নেই। তাই পাহাড় সমান কেলেঙ্কারি আর নারীদের প্রতি এ ধরনের অত্যাচারের ঘটনা ঘটে চলেছে। যত সু- সাহিত্য চর্চা হবে, ততই মানুষ আবার মনুষ্যত্বের পথে ফিরে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কবি বিজয়কুমার ভট্টাচার্য, কবি-সাংবাদিক বিমলকান্তি দাস, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখক নবারুণ দে, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী গৌতম ভট্টাচার্য, পুর কমিশনার দিলীপকুমার পাল, বিশিষ্ট নাগরিক নবেন্দুকুমার দাস, কবি মৃদুলা ভট্টাচার্য, শিল্পী বারীন্দ্রকুমার দাস, সমাজকর্মী অঞ্জন চৌধুরী প্রমুখ। সব বক্তাই সমাজ জীবনে সাহিত্যের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের উল্লেখ করেন এবং পড়াশোনার দিকে মানুষ যত ঝুঁকবে ততই সমাজ জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
[ সৌজন্যে, দৈনিক যুগশঙ্খ ]